সালাহ উদ্দিন শুভ্র

  ২৭ জুলাই, ২০১৮

সরল কবিতার গভীর সৌন্দর্য

কালজয়ী রাশিয়ান লেখক লিও তলস্তয় বলেছিলেন, যেখানে সারল্য নেই তা মহৎ হতে পারে না। ‘হোয়াট ইজ আর্ট’ নাম দিয়ে লেখা বিশাল এক প্রবন্ধের বইয়ে লিও তলস্তয় জানিয়েছেন, শিল্প হচ্ছে মানুষের জন্য মানুষের সৃষ্টি। তার মতে, শিল্পের মধ্যে থাকবে সেই ঐকতান যা মানুষ মানুষের জন্য উপস্থাপন করবে। তার তত্ত্বানুযায়ী মহৎ শিল্পের এই সরল বৈশিষ্ট্য থাকবে, যা মানুষের স্বাভাবিক জীবন ও যাপনের প্রতিরূপ। জটিল অথবা কাল্পনিক হতে হবে এমন দিব্যি থেকে তলস্তয় শিল্পচর্চাকে মুক্তি দিচ্ছেন। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, সরলার্থেও শিল্প মহৎ হয়ে উঠতে বাধা নেই বা মহৎ শিল্পের গুণ হলো তার সরল থাকা।

বাংলা কবিতায় এসব সরল বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার দিন এখন নেই বলতে গেলে। অথবা সরল কবিতার দিন বাংলায় আসেওনি বলা চলে। মাইকেল মধুসূদন যে কবিতা চর্চা করেছেন, তাতেও সরলতা আছে এক অর্থে। কিন্তু ভাষার কারণে তা এখন জটিল মনে হবে আমাদের কাছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা আবার জটিল। আধুনিক জীবনের ব্যক্তি মানুষের উদ্দেশ্যহীন রোগ ও অনুভূতিমালা ব্যক্ত হয়েছে তার কবিতায়, সেসব জটিল। সরল হলো সেই তলস্তয়ের পথ, অনেকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত থাকতে দেখা ও তা তুলে আনা।

বাংলা ভাষার এক কবি মুহাম্মদ জাকির হোসেন খান সরল কাব্যচর্চা করেন। ?‘প্রভাতের ফেরিওয়ালা’ বইয়ে তার সরল উক্তি ও উপলব্ধির প্রকাশ রয়েছে। তিনি মানবতাবাদের কবি। নিছক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, খেয়ালখুশি মতো ঘুরে বেড়ানোর অধিকার প্রতিষ্ঠার সীমানায় তিনি আবদ্ধ নন। তিনি বরং আরো বড় অর্থের মানবতাবাদী। তার দার্শনিক উপলব্ধিও কাউন্টেবল। বাংলায় সুফিবাদের যে দর্শন পাওয়া যায়, জাকির হোসেন খান তার অনুসারী।

এই কবির কয়েকটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করে তাকে বোঝার চেষ্টা করি। ‘সংস্কৃতি ও সভ্যতার নগরী ঢাকা/অনাচার ও লোলুপতায় সর্বৈব ঢাকা,/ফ্ল্যাটের দরোজাগুলো/ভালোবাসার দু’হাত হয়ে/মানবতাকে জড়িয়ে ধরে না,/বরং সিন্দুকের দরজা হয়ে/নিজ স্বার্থেই খুলতে অভ্যস্ত।’ -ন্যুব্জ ঢাকা। ঢাকায় বিপুল পরিমাণ নাগরিক যে বসবাস করছে, তাদের জীবনাচার কেমন, তারা কী নিয়ে বাস করছে? এই প্রশ্নের সরল উত্তর জাকির হোসেন খান দিয়েছেন। তিনি বলছেন ঘর বলে যাকে আমরা তৈরি করেছি, তাকে সম্পদ, লোভ, জাগতিক বৈভবের সিন্দুকে পরিণত করেছি। আমরা বস্তুত সংসার বলতে সিন্দুকে জীবনযাপন করছি। ভালোবাসার দুটি হাতও আমাদের জন্য হয়ে রয়েছে শক্ত কপাট।

তাহলে সংসার বা মানবজীবন কি? এ বিষয়ে কবির মতÑ ‘তাতেও কি মানব মনে স্বস্তির বৃষ্টি ঝরে?/অহর্নিশ খুঁজে ফিরে নিশ্চিত ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।/আসলে জীবন কি জানে/ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনে/কিসে তার স্থায়ী নিশ্চয়তা?’ -সময়ের কথকতা। অর্থাৎ নিশ্চয়তা যে মানুষ খুঁজছে, সেখানেই তার জীবনযাপন অসরল হয়ে পড়ছে। কিসের নিশ্চয়তা সে চায়। ক্ষণস্থায়ী জীবন যেখানে, সেখানে নিশ্চয়তাটা কী জন্য, কার জন্য। এটা হতাশার বা নৈরাশ্যেও উক্তি নয়। বংশপরম্পরা টিকিয়ে রাখতে, নিজেদের ভালো রাখতে মানুষ যে উপায় বেছে নিয়েছে সম্পদ সঞ্চয়ের, আর্থিক লাভালাভের, সেই নিশ্চয়তা কী আদৌ আসে, না শান্তি আসে?

তাহলে মানুষের জীবনের বেঁচে থাকার সংকট হচ্ছে উপলব্ধিজাত মূলত। বেঁচে থাকার গূঢ় উদ্দেশ্য বুঝতে না-পারার সংকট। জাকির হোসেন খান আরেক কবিতায় লিখেছেন- ‘ক্লান্ত ও দিকভ্রান্ত মন/খুজে পেতে পারে প্রকৃত সত্যের,/সত্য জ্ঞানের অনুসন্ধানে প্রয়োজন/চাক্ষুষ তথ্যভিত্তিক যুক্তি নয়/সত্যের শর্তহীন বিশ্বাসে/কেননা যুক্তি অবারিত,/সত্য একটাই।’ -সত্য জ্ঞান। জীবনে সমৃদ্ধির, ভালো থাকার, ভালোবাসার সংকটের সমাধান তাহলে বিশ্বাস। যাকে আমরা সত্য বলে জানব, তাকে বিশ্বাস করেই জানব। তথ্যভিত্তিক যুক্তি দিয়ে নয়। সংসার সুখের হবে বিশ্বাসের গুণে। সংসার ও দুনিয়ার জীবনে এই বিশ্বাস গায়েব থাকবে, তাকে দেখা যাবে না, কিন্তু তার উপস্থিতি টের করা যাবে। এই সত্য অনেক মানুষের উপস্থিতিতে হবে, প্রকৃতির মধ্যে থেকে হবে, এই সত্য সরল।

আরেকটি কবিতায় এই বিশ্বাসই কেন আমাদের উপলব্দিকে, মনের দুয়ারকে ফ্ল্যাটের ঘেরাটোপ থেকে বের কওর আনতে পারবে তার ইশারা আছে। অসীমের সীমারেখা কবিতায় আছে, ‘অনন্তের মাঝে হারানো নয়/অনন্তকে বুকে ধারণ করে/অন্তহীন আলোকবার্তা হয়ে/জীবন হয়ে উঠুক/আনন্দময়, ভোরের স্নিগ্ধতা।’ তাহলে জাকির হোসেন খানের প্রস্তাবনা দাঁড়াচ্ছে এই যে, অনন্তকে সীমিত করার যে চেষ্টা তাতে জগতের সব কষ্ট নিহিত। বরং অনন্তকে বুকে ধারণ করতে হবে। এই অনন্ত জগতের সব মানুষের আত্মার অনন্ত, প্রকৃতি ও মহাজগত মিলিয়ে অনন্ত। মানুষের বিস্ময়ানুভূতিকে নষ্ট করে দেওয়া সসীমতা, যন্ত্র-প্রকৌশলে দুনিয়াকে বুঝতে চাওয়ার কবিতা এ নয়। মানুষকে বুঝতে হবে- ‘আশা হারানো পাপ মানুষের’।

জাকির হোসেন খানের কবিতায় সরাসরি রাজনৈতিক প্রশ্ন আছে, আছে বর্তমান পরিস্থিতির করুণ বিবরণও। তিনি কবিতা লিখেছেন রোহিঙ্গাদের নিয়ে, হাওরের কৃষকদের নিয়ে, তার কবিতায় আছে গণতন্ত্রহীনতার কথা, গুম হওয়ার কথা। তিনি পরিবেশেরও কবি। হাওরের কান্না কবিতায় আছে- ‘কৃষকের সুখ স্বপ্ন যায় হারিয়ে,/হারিয়ে যায় স্বপ্ন প্রেয়সী হয়ে উঠা/বাড়ন্ত- ধানের শীষ/আগত আষাঢ় কৃষকের মনকে ভাসায় অনিশ্চয়তার সাগরে,/স্বপ্নগুলো মরিচীকা হয়ে/হারায় প্রত্যাশার বালুচরে।’ মানুষের প্রেয়সীকে তিনি ধানের শীষের রূপক হিসেবে তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ মানুষ তখনই ভালো থাকে যখন পরিবেশ ভালো থাকে আবার পরিবেশ ভালো থাকার সঙ্গে মানুষের ভালো থাকাও অপরিহার্য। প্রকৃতির সঙ্গে প্রেমের সুক্ষ্ম অথচ তীব্র একটি সুর তার কবিতায় স্বপ্রাণ বয়ে চলে।

তিনি সরল মনের কবি, মানবিক বিপর্যয়ের মুখে সজল নয়নে চেয়ে থাকেন। তবু আশা হারান না। সুন্দরের জয় হবে এদেশে- এই বিশ্বাস তার আছে। তার বইয়ের কবিতাগুলো আশা করি পাঠক পড়বেন। নিজেদের সঙ্গে এর একটা মিল খুঁজে পাবেন তারা। মানবিক বিপর্যয় থেকে উদ্ধার পেতে যে দার্শনিক ইশতেহার তিনি হাজির করেছেন, মুক্তির পথ এদিকে বলেই মনে হবে অনেকের।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist