শুভানন্দ সেনরায়
পরাগায়ন অথবা কবিতার নিখিল ভুবন
একজন দূরের কবির কবিতা পড়লাম। হ্যাঁ, তিনি মার্কিন মুলুকে থাকেন। তার বইটি পেয়ে এতটাই আপ্লুত হলাম যেÑ মনে হলো, এমন কবিতা দীর্ঘদিন পড়িনি। কেন পড়িনি! আমাদের চারপাশে এত কবিতার বিস্তার। তাহলে কবিতা নেই কেন! আমি জীবনানন্দ দাশকেই স্মরণ করি। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। এ প্রশ্নও আসতে পারে, কবিতা কি সবার জন্যে! কবিতা কি সবাই লিখতে পারেন কিংবা পড়তে!
কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি, একজন মৌলিক কবি। তবে কি কেউ কেউ ‘যৌগিক’ও আছেন? হ্যাঁ, আছেন। তারাও দিনরাত লিখেন। কী লিখেন তা তারা নিজেরাই জানেন না। ফেসবুকে লিখেন। অনলাইন-অফলাইনে লিখেন। দাবি করেন একটা নতুন কিছু করছেন! দাবি সে কেউ করতেই পারেন। সকল দাবি কি প্রকৃতির কাছে গৃহীত হয়! ওর ‘কাব্যনাম’ কবিতাটির দিকে আমরা দৃষ্টি দিতে পারি। কবি লিখছেনÑ
‘হিম হয়ে থাকি। থাকি হেমন্ত হয়ে। এখনো/শীত আসেনি, তবু বরফজলে মেশানো মেঘ/উড়ে যায়। পাতায় পাতায় জমা হয় রোদ।/জমা হয় বিশ্বাসের পরাগায়ন, বোধের বাতিগ্রন্থÑ/বপনের ব্যাপৃত বিনয়।/বিচিত্র ভালোবাসা নিয়ে যারা মায়ালোক সাজায়/তাদের অভিজ্ঞতায় জমা থাকে কিছু পূর্বশর্ত।/বিমূর্ত সমুদ্রের মাঝখানে যে ছায়া জেগে থাকেÑ/একদা তারও নিজস্ব ঠিকানা ছিল,/এ কথা ভেবে ঢেউগুলো কাঁদে।/আর পাখিরা কাঁদে, মানুষের অপারগতা দেখে।/ঋতুতে ঋতুতে পরাগের বিবর্তন জানিয়ে যায়,/সকল কুসুমজীবনেই লেগে থাকে রং,/অধিগ্রহণ শেষ হলেÑ/সেই রং মিশে যায় প্রতিটি/প্রাণের প্রভায়। প্রতিটি স্পর্শের মুগ্ধ করতলে।
[পরাগায়নের পূর্বশর্ত ]
প্রিয় পাঠক, দেখুন কীভাবে তিনি তার কাব্য-পরাগায়ন সম্পন্ন করেছেন। একজন শক্তিমান কবিই এটা পারেন। আমরা ফিরতেই পারি জীবনানন্দ দাশের কাছে। তিনি তার ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে লিখছেনÑ ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি; কবি, কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সবাইকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভেতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’ ফারহানা ইলিয়াস তুলির কবিতায় একটি প্রাকৃতিক নির্ঝাস লক্ষ্য করি। তিনি সমাজ ও প্রজন্মের মাঝে সেতুবন্ধনের জন্য কাজ করেন তার কবিতায়। এমন অনেক পঙ্ক্তিমালা এখানে চয়ন করা যেতে পারে।
১. সমুদ্রে নয় বরং ডাঙায় হা করে আছে/প্রকা- নীল তিমি। যে আত্মঘাতক সময়/তার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, আমরা কেউই/তাকে শনাক্ত করতে পারছি না।
২. পাতায় গেঁথে দিচ্ছি দক্ষিণ। পাথরের গায়ে গায়ে/গুঁজে রাখছি আশ্বিনের বর্ণফুল।এই প্রান্তরÑ/আমার নয় জেনেও, তাকে করে যাচ্ছি/শ্রাবণের পাঠ দান।
৩. যে জিরাফ সময়ের গলায় আমরা মালা দিতে চাইছি,/তা আমাদের সহচর নয়। তবু বলছি, ভালো আছিÑ/তুমিও ভালো থেকো মাটি, থেকো পলির পরমাণু হয়ে,/আমাদের লালিত ফসলে প্রেমের পেখম তুলে যেমন/হাওয়া বয়ে যায়। যেমন ভরা নদীতে ভাসে জীবনের নৌকো।
৪. সাজিয়ে রাখছি রহস্যের পত্রকোরক, যারা ভেদ করতে জানে/বাতির দৃশ্যান্তর; শুধু তাদের জন্যেই আঁকছি বিদ্যুতের বহুমাত্রাÑ/লিখছি শান্তিময় আকাশের জন্য একটি নতুন মেঘাভিধান।
তুলির কবিতা কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় পড়েছি। ওর স্বর উঁচু নয় কবিতায়। কিন্তু যা বলছেন তিনি তা আমাদের ভাবায়। এই যে ভাবানোর ক্ষমতাÑ সেটাই একজন কবিকে স্মরণীয় করে রাখে। কবিতার ইন্দ্রজালে তুলি যে অসম্ভবকে দেখেনÑ সেই দেখা পৃথিবীর কোটি মানুষের।
নির্জনতম ভালোবাসার আখ্যানে কবিতা শুধু ভোলায় না, সঞ্জীবিতও করে। কবিতা শুধু ছায়া আর রোদ নয়। একটি কঠোর সত্যও। একজন পরিপূর্ণ কবির হাতে জন্ম নেওয়ার পরে কবিতা হয়ে ওঠে সত্য, সুন্দর, ঐশ্বরিক আভায় আলোকময় এক নান্দনিক কাঠামো। যা মানুষকে আনন্দ দেয়, পথ দেখায়, স্বপ্নাবেশে আবিষ্ট করে, অনাগত ভবিষ্যতের নুপুর কিংবা বৃষ্টির পরিণত আওয়াজ শোনায়। তুলির কবিতায় আমি সেই আওয়াজ পাই। চমৎকার প্রচ্ছদে এই বইটি পাঠকের অবশ্যই পড়া দরকার। কারণ, এই কাব্যগ্রন্থ থেকে আগামীর পাঠক অনেক ভাবনার খোরাক পাবেন। তা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি।
পরাগায়নের পূর্বশর্ত
ফারহানা ইলিয়াস তুলি
তিউড়ি প্রকাশন, ঢাকা
প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত
মূল্য : ১৩৫ টাকা, ৭ ডলার
"