ফকির ইলিয়াস

  ০৬ জুলাই, ২০১৮

নিউইয়র্কের বইমেলা

পাঠকের আলোময় চোখ

নিউইয়র্কের বইমেলা ২৭ বছর পার করেছে। এ এক অভিনব অগ্রযাত্রা। বইমেলা ঘিরে এবার অনেক নতুন লেখক নিউইয়র্কে এসেছিলেন। তারা বাংলাদেশে নিজেকে অনেক ‘বড়’ লেখক মনে করেন বোধ হয়। কেউ কেউ পিএইচডিও করেছেন। তাদের পিএইচডির বিষয়-‘মানিক বন্দোপাধ্যায়ের গল্পে নিম্নবর্গ’, ‘বাংলাদেশের হিজড়া সমাজ’, ‘কামার সম্প্রদায়ের অতীত ও বর্তমান’- এমন অনেক বিচিত্র বিষয়। কাজগুলো ভালো। কিন্তু তাদের পাঠক কম।

উদার আমেরিকান অ্যাম্বাসি তাদের লেখক হিসেবে গণ্য করেছে ও ভিসাও দিয়েছে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু এসব লেখকদের একটি বড় সমস্যা আছে- তারা বিদেশে এসে বিদেশের বাঙালি লেখকদের রিকোগনাইজই করতে পারেন না। তারা যেন এসব লেখকদের নামই শোনেননি! অন্যভাবে বলতে পারি, ইউরোপ আমেরিকায় যেসব প্রথম শ্রেণির পাঠক আছেন-তারাও ওসব ডক্টরেট লেখকদের দু-চার লাইনই পড়েননি কোথাও। না জাতীয় দৈনিকে, না লিটল ম্যাগাজিনে। বই বের করে তারা ঘরের কোণা ভরিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ উপন্যাস লিখে নিয়ে এসেছেন-‘রিক্সা ড্রাইভার’, ‘নীল আলো’, ‘তোমাকে পাওয়ার সুখ’-এমন অনেক চমকপ্রদ নামের। অথচ, তারা অভিবাসী অনেক গুণী লেখকের নামই শোনেননি!

যাক সে প্রসঙ্গ। মুক্তধারা আয়োজিত তিন দিনব্যাপী বইমেলা উদ্বোধন করে প্রখ্যাত নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেছেন, বাংলা একাডেমির বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা, সেই আদলে গত ২৭ বছর ধরে নিউইয়র্কে মুক্তধারার আয়োজনে বইমেলা ভালোভাবে হচ্ছে এটা সত্যিই বিস্ময়। আমার মনে হয়, বাংলা একাডেমির বই মেলার সম্প্রসারণ হচ্ছে নিউইয়র্কের বইমেলা। ভালো লাগছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্ম পা-ুলিপি তৈরি করেছে এবং তারাই তা উপস্থাপন করেছে। তিনি আরো বলেন, বাঙালি জাতির ভিত্তি হচ্ছে তার ভাষা এবং সংস্কৃতি। সেই ভাষা এবং সংস্কৃতির জয়গান আমরা এখানে দেখছি।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, বইমেলা মানেই মনের খোরাক, পরিবর্তনের হাতিয়ার এবং মানবিকতার হাতিয়ার। তিনি নিউইয়র্কের বইমেলা সম্পর্কে বলেন, এই বইমেলা বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় উত্তীর্ণ করেছে।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করা হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানের। ড. নূরন্নবীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে অংশগ্রহণ করেন গণআদালতে অংশ নেওয়া আমেরিকান অ্যাটর্নি টমাস কিটিং এবং জাহানারা ইমামের ছেলে সাইফ ইমাম জামি।

লেখক বঙ্গবন্ধু ও তার অপ্রকাশিত পা-ুলিপি নিয়ে বক্তব্য রাখেন শামসুজ্জামান খান। শামসুজজ্জামান খান বলেন, লেখক হিসাবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন বিস্ময়কর লেখক। রাজনীতিবিদ না হলে একজন ভালো লেখক হতেন। যুদ্ধের সময় কীভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পা-ুলিপিগুলো উদ্ধার করেছিলেন, তা-ও তিনি উল্লেখ করেন। বলেন, বঙ্গবন্ধু জেলে বসে এইগুলো লিখেছিলেন। একটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম বই প্রকাশ করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেছিলেন, মুজিবের পক্ষে বই লেখা সম্ভব নয়, প্রথম বই প্রকাশিত হবার পর তার হাতে একটি বই দিয়েছিলাম। পরে তিনি বলেছিলেন, মুুজিবের পক্ষেই বই লেখা সম্ভব। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পশ্চিম নয়, আমাদের পূর্বে থাকতে হবে। আরেকটি ঘটনা তিনি উল্লেখ করে বলেন, ৭ মার্চের ভাষণের পূর্বে বেশ কয়েকজন মিলে তাকে ভাষণ তৈরি করে দিয়েছিলেন। পরে দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর হাতে সেই কাগজ নেই। তিনি তার মতো করেই ভাষণ দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে তিনি বঙ্গবন্ধুর আগামী বইয়ের কিছু অংশ পাঠ করে শোনান।

অনুষ্ঠানে অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বলেন, ছোট বেলায় সাহিত্য নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল না, তবে আমার বাবার আগ্রহ ছিল। আমি যখন কলেজে উঠি তখন আমি যেন সাহিত্য পাগল হয়ে গেলাম। ৮ বছর সাহিত্য ছাড়া আর কিছুই বুঝতাম না। সাহিত্যে আনন্দ পেতাম, কবিতায় আনন্দ পেতাম, গল্পে আনন্দ পেতাম। ওই সময় আমি যে আনন্দ পেয়েছি, তা সারা জীবনেও পাইনি। সেই আনন্দ সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষক হয়েছি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছি। তিনি আরো বলেন, আমি সব সময় ভালো শিক্ষকদের ক্লাসে যেতাম। আমাদের একজন অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন, তার ক্লাস নেওয়ার পর মনে করেছি কখনো যদি পড়তে হয় অর্থনীতিতে পড়ব। যুদ্ধের সময় অনেকের সঙ্গে তিনিও ভারত চলে গিয়েছিলেন। এরপর একজন নতুন শিক্ষক এসেছিলেন। তার ক্লাসেও গিয়েছিলাম। তার ক্লাস নেওয়ার পর আমার কাছে মনে হয়েছে, অর্থনীতি হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ বিষয়। কেউ যেন এই বিষয়ে না পড়ে। আবার আমি সাহিত্যে ফিরে এলাম, এখন পর্যন্ত চলছে। আমি মনে করি, মানব সভ্যতার সব কিছুই সাহিত্যে। কেউবা আবার মনে করে সাহিত্য মানে বিপ্লব, সাহিত্য মানে গোলাম। আমি মনে করি সাহিত্য মানুষকে উন্নত করে, মানুষকে বড় করে, তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে, জীবন পরিবর্তন করে, জীবন সুন্দর করে। এখনকার সাহিত্য তো মনে হয় টাকা। তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি মানুষকে আনন্দ দিতে চাই, বিনোদন নয়। আনন্দ দিয়েই মানুষের মনের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই।

এ বছর মুক্তধারা-জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, যার মূল্যমান ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে চিত্তরঞ্জন সাহা প্রকাশক পুরস্কার পেয়েছে ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’। এবারের বইমেলায় পাঠক আলোকিত বইগুলো কিনেছেন। অবশ্য এই প্রবাসে এমন অনেক লেখকও আছেন যারা খ্যাতিমান লেখকের লেখা না পড়েই নিজে বই লেখেন এবং এগুলো পুশিং সেলও করেন। বিষয়টি এ রকম, তারা বড় বড় লেখককেও তাদের এসব আনাড়ি বই কেনার কথা বলে বিব্রতকর অবস্থার মাঝেই ফেলে দেন।

পঠন পাঠনের কিছু শর্ত থাকে। ভালো বই না পড়লে মননকে শাণিত করা যায় না। এই কথাটি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আয়োজিত সাহিত্য মেলায় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বেশ জোর দিয়েই বলেছেন। কিন্তু তারপরও পাঠক কই! কে শুনবে কার কথা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ২৯, ৩০ জুন তাদের সাহিত্যমেলায় ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টে কেন্দ্রের বই বিক্রি করেছে। একটি পরিশীলিত সমাজ গঠনে বইয়ের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বাঙালি পাঠক সেই সিঁড়ি অতিক্রম করবে কবে!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist