তন্ময় আলমগীর

  ১১ মে, ২০১৮

গীতাঞ্জলি

নোবেলপ্রাপ্তির আগে ও পরে

খ্যাতনামা ইংরেজ চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোটেনস্টাইন ১৯১১ সালে কলকাতায় আসলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ওই সময়ে অন্যদের অনূদিত সাহিত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গল্প-কবিতা তাকে বেশ মুগ্ধ করে। দেশে ফিরে গিয়ে তার সম্পর্কে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দেন। সেই আগ্রহের সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ নিজের অনুবাদের পা-ুলিপি রোটেনস্টাইনের হাতে তুলে দেন। পা-ুলিপিটি এখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে।

রোটেনস্টাইন এতটাই বিমোহিত হন যে, স্টপফোর্ড ব্রুক, এ সি ব্রাডলি ও কবি ডব্লিউ বি ইয়েট্সের কাছে অবিলম্বে পা-ুলিপি পাঠিয়ে দেন। পা-ুলিপি পড়ে ইয়েট্স কেবল এর ভাবগাম্ভীর্য দ্বারা আকৃষ্ট হননি, এর ভাষাও তার পুরোপুরি অনুমোদন লাভ করে। ইয়েট্সের ভূমিকাসহ ইন্ডিয়া সোসাইটি কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। ‘গীতাঞ্জলি’ মূলত রবীন্দ্রনাথের ১০টি কাব্য ও নাটকের বাছাইকৃত সংকলন। এতে ১০৩টি কবিতার কবিকৃত ইংরেজি অনুবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়।

প্রকাশের বছরখানেকের মধ্যে ১০টি সংস্করণ বের হওয়াই প্রমাণ করে, পাঠকের মনে কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’।

স্টার্জ মুর প্রথম রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদানের প্রস্তাব করেন। সেই প্রস্তাবে সুনির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেননি। স্টার্জ মুর ছিলেন রয়াল সোসাইটি অব লিটারেচার অব দ্য ইউনাইটেড কিংডমের ফেলো। সেই পদাধিকারবলেই তিনি প্রস্তাব করতে সক্ষম হন। নোবেল সাহিত্য পুরস্কার কমিটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম নিয়ে মতানৈক্য ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সুইডিশ একাডেমিতে বাংলা জানা একজন সদস্য ইয়েসিয়াস হেনরিক ভিলেম তেগনারসহ পের হালস্ট্রোম ও গুস্তাফ ফারনার ফন হাইডেলস্টাম ‘গীতাঞ্জলির’ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পুরস্কারপ্রাপ্তিতে অনেকটাই এগিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথকে। যদিও নোবেল কমিটির সভাপতি হারাল্ড হিয়ার্ন ‘গীতাঞ্জলি’ ভারতীয় ধ্রুপদি সাহিত্য থেকে আহরিত কি না, তা ভেবে ভ্রু কুঁচকাচ্ছিলেন। তবু শেষ পর্যন্ত ১৩ জন সদস্যের ১২ জনই সমর্থন করলে নিশ্চিত হয় রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করলে দেশে-বিদেশে শুরু হয় তোলপাড়। ভারতীয় উপমহাদেশে তেমন কানাঘুষা না হলেও ব্যাপক সমালোচনার ঝর বয়ে যায় ইউরোপে। বিশেষ করে ইংরেজ কবি টমাস হার্ডি পুরস্কারবঞ্চিত থাকায় ইংরেজরা মেনে নিতে পারেনি। তৎকালীন প্রভাবশালী এই কবির নোবেলপ্রাপ্তিতে ইংরেজরা ছিল সন্দিহান। তাকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের হাতে নোবেল চলে যাওয়ায় তাদের আঁতে ঘা লাগে। অখ্যাত, অশ্বেতাঙ্গ রবীন্দ্রনাথকে পুরস্কৃত করায় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন পত্রিকাতে তাকে ও তার স্বীকৃতিকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছিল। খোদ ভারতীয় কিছু পত্রিকাও এতে সায় দিয়েছে সমানতালে। ঈর্ষায় জর্জরিত কতিপয় পত্রিকা বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছিলÑ দেখিতে দেখিতে জগতের সাহিত্য এত দরিদ্র, প্রায় দেউলিয়া হইয়া গিয়াছে যে, রবীন্দ্রনাথ সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন গণমানুষের কবি। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মহামোহবদ্ধ মুক্ত চেতনার সম্মিলন ঘটানোর মহান প্রয়াস থাকত তার কবিতায়। প্রেমের, ধ্যানের, জ্ঞানের, জগতের অচেনা অজানা বিষয়কে বাস্তবিক লব্ধতায় চিহ্নিত করাও ছিল তার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট। কিন্তু ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বসাহিত্যে পরিচিত করিয়ে দেয় এক মরমী বাউল কবি হিসেবে। অস্থিরচিত্ত আধুনিক পাশ্চাত্য জগতকে রবীন্দ্রনাথ চিরকালীন ভারতের শান্তির বাণী শুনিয়েছেন বলে নোবেলপ্রাপ্তির পর তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ‘গীতাঞ্জলির’ ভূমিকায় ইয়েট্স তা স্বীকার করার পাশাপাশি সুইডিশ একাডেমিও কাব্যটিকে বছরের সেরা আদর্শবাদী কাব্য বলে অভিহিত করেছে।

মানুষের চিরকালীন আবেগ-অনুভূতি এবং সমকালীন জীবনের নানারকম ঘাত-প্রতিঘাত যে রবীন্দ্র-কাব্যের মূল বিষয়; ‘গীতাঞ্জলির’ পর পাশ্চাত্য সাহিত্যে তা অজানাই থেকে গেল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন সমসাময়িক বিশ্ব এবং সংকট নিয়ে কিছু লিখতে গেলেন, তখন অধিকাংশ পাঠকের চোখ অবিশ্বাসী হয়ে ওঠল। এমন ভয়ঙ্কর সীমাবদ্ধতা থেকে রবীন্দ্রনাথকে বেড়িয়ে আসতে লেগেছিল অনেক সময়।

‘গীতাঞ্জলি’ শুধু রবীন্দ্রনাথকে নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করেছে। বিশ্বসাহিত্যের চোখে বাংলাভাষাকে স্থান করে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। ভারতবর্ষ ও এশিয়ার জন্য বয়ে নিয়ে এসেছে গর্বিত সম্মান, সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist