মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

  ০৪ মে, ২০১৮

রবীন্দ্রনাথের ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ লেখনীর গুণে বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে বিপুল পাঠকশ্রেণি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতো অনেকে কেবল রবি ঠাকুরের রচনাকে ভালোবেসে বাংলা ভাষাকে আত্মস্থ করেছিলেন। আবার জাপানি কাজুও আজুমার মতো অনেকে রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং অন্যকে পাঠে উদ্বুদ্ধও করেছেন। আবু সয়ীদ আইয়ুব কিংবা কাজুও আজুমার মতো রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ একজন পাঠক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। তিনি আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পো দুই মহাদেশে জন্মগ্রহণ করলেও শিল্পচর্চা তাদের দুজনকে একবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আলাপচারিতার সুযোগ দিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের জীবনে যে কজন বিশেষ নারীর আগমন ঘটেছিল, ওকাম্পো তাদের একজন। রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোর প্রতি বিশেষ মুগ্ধ ছিলেন। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার চিন্তা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রভাবিতও ছিলেন। ১৯১৪ সালে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়েন। অন্য পাঠকদের মতোই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিরাজ্যে প্রবেশ করে ওকাম্পো আবিষ্ট হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কাকতালীয়ভাবে। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ পেরু ও মেক্সিকো ভ্রমণ করছিলেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে রবীন্দ্রনাথ আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে অবস্থান করেন। কবির এ অবস্থানের খবর শুনে ছুটে আসেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। তিনি রবীন্দ্রনাথকে তার বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানান। রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো প্রথম দর্শনেই রবীন্দ্রনাথকে দেখে শিহরিত হয়েছিলেন। তার স্মৃতিকথায় রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দর্শনের বিষয়ে লিখেছেন, ‘প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এ-ও সত্যি যে, ঘরে যেন তিনি নেই। তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী। অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোনো দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তার সোনালি শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তার সমগ্র মুখাবয়বের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তার কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব।’ অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথও ওকাম্পোর আতিথ্য গ্রহণকালে তার কর্মকা-, গুণ ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের আচরণে, কবিতায়, চিঠিতে ওকাম্পোর প্রতি তার প্রীতি আমরা প্রবলভাবে লক্ষ্য করি।

ওকাম্পো ছিলেন নারীবাদী লেখক, সামাজিক কর্মী। রবীন্দ্রনাথকে আমরা যে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ হিসেবে পাই, তার পেছনেও ওকাম্পোর বিশেষ অবদান রয়েছে। অন্যদিকে ওকাম্পোর কর্মতৎপরতা ও চিন্তা দেখেই নারীদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভুল ধারণা ভেঙে যায়। আমাদের মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ একদিন লিখেছিলেন, ‘আজকাল একদল মেয়ে ক্রমাগত নাকী সুরে বলছে, আমরা পুরুষের অধীন, আমরা পুরুষের আশ্রয়ে আছি, আমাদের অবস্থা অতি শোচনীয়। তাতে করে কেবল এই হচ্ছে যে, স্ত্রী পুরুষের সম্বন্ধবন্ধন হীনতাপ্রাপ্ত হচ্ছে। অথচ সে বন্ধন ছেদন করবার কোনো উপায় নেই।’ অন্যত্র লিখেছেন, ‘সাহিত্যে, কলায়, বিজ্ঞানে দর্শনে ধর্মে, বিধিব্যবস্থায় মিলিয়ে আমরা যাকে সভ্যতা বলি সে হলো পুরুষের সৃষ্টি।’ ‘প্রকৃতিই রমণীকে বিশেষ কার্যভার ও তদনুরূপ প্রবৃত্তি দিয়া গৃহবাসিনী করিয়াছেন, পুরুষের সার্বভৌমিক স্বার্থপরতা ও উৎপীড়ন নহে, অতএব বাহিরের কর্ম দিলে তিনি সুখীও হইবেন না, সফলও হইবেন না।’ অথচ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তাকে বদলে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ জানলেন তার এতদিনের চিন্তায় ভুল ছিল। রবীন্দ্রনাথই ওকাম্পো-সাক্ষাতের পরবর্তী সময়ে বলেছেন, ‘এ দিকে প্রায় পৃথিবীর সব দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গ-ি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এশিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ সর্বত্রই সীমানা-ভাঙার যুগ এসে পড়েছে। যে সকল দেশ আপন আপন ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রিক প্রাচীরের মধ্যে একান্তবদ্ধ ছিল তাদের সেই বেড়া আজ আর তাদের তেমন করে ঘিরে রাখতে পারে না, তারা পরস্পর পরস্পরের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।’ অনেক গবেষক মনে করেন, শেষের কবিতায় আমরা যে লাবণ্যের সন্ধান পাই, সে চরিত্রের মধ্যে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ছায়া রয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ তার ছদ্মনাম দিয়েছিলেন ভানুসিংহ ঠাকুর। রবি অর্থ সূর্য, অন্যদিকে ভানু অর্থও সূর্য। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ছন্মনামে লিখলেও তার নামের তাৎপর্য ঠিকই ভানুসিংহের মধ্যে লুকায়িত ছিল। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে একটি নামে ডাকতেন। ভিক্টোরিয়া শব্দটিকে বাংলায়ন করে নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয়া’। ওকাম্পোর আতিথ্যে কবিগুরু প্রায় দুই মাস ছিলেন এবং ওই সময় প্রায় ৩০টি কবিতা রচনা করেন। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত পূরবী কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে উৎসর্গ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পো পরস্পরের মধ্যে কমপক্ষে অর্ধশত চিঠি চালাচালি করেছেন। প্রথম সাক্ষাতেই যে ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের মন জয় করে নিয়েছিলেন সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় তার লেখা সে সময়ের কবিতাগুলো ঘাটলে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ওকাম্পোকে চিঠিতে লেখেন, ‘তুমি জানো যে, ভাস্বর সেই দিনগুলি আর তার কোমল শুশ্রƒষার স্মৃতিপুঞ্জ ধরা আছে আমার কবিতাগুচ্ছে, হয়তো আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা (পূরবী)। পলাতক স্মৃতিগুলি আজ কথায় বন্দি। ...তোমাকে নিশ্চিত বলতে পারি যে, এ কবিতা বেঁচে থাকবে অনেক দিন।’ অথচ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওকাম্পোর দেখা হয়েছিল মাত্র দুবার। ১৯১৪ সালের পর দ্বিতীয়বার তার সঙ্গে দেখা হয় ১৯৩০ সালে প্যারিসে। দ্বিতীয়বারও ওকাম্পো কবিগুরুর জন্যে যথেষ্ট করলেন। অনেক খেটেখুটে প্যারিসে প্রখ্যাত ‘পিগাল গ্যালারি’তে কবিগুরুর আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর আর তার সঙ্গে কবিগুরুর দেখা হয়নি।

রবীন্দ্রনাথের জীবনে ওকাম্পো প্রথম নারী ছিলেন না। ওকাম্পোর জীবনেও রবীন্দ্রনাথ প্রথম পুরুষ নন। বলা হয়ে থাকে, ওকাম্পো গুণী ও সুদর্শন পুরুষের প্রতি বরাবরই আসক্ত ছিলেন। অনেক সুদর্শন বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে ওকাম্পোর প্রণয় ছিল। প্রণয় ছিল বিখ্যাতদের বাইরের ঘরানার মানুষদের সঙ্গেও। কিন্তু এসব বিষয়-আশয় রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে ওকাম্পোকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি আক্ষেপ ছিল। কবিগুরু চাইতেন তার বিজয়া শান্তি নিকেতনে আসুক, কটা দিন কাটিয়ে যাক। তিনি ওকাম্পোকে এ ব্যাপারে চিঠিও লিখেছিলেন, ‘প্রিয় বিজয়া, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাই তুমি তোমার ভ্রমণসূচি ভারতবর্ষে রাখো একবার, আমার নিজের জায়গা শান্তিনিকেতনে এসে আমাকে দেখে যাও। অসম্ভব কেন হবে? নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া খুব ভালো এখানে এবং তোমাকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখবার চেষ্টায় আমার কোনো ত্রুটি হবে না।’ কিন্তু ওকাম্পো তখন তার সম্পাদিত ‘সুর’ পত্রিকাটি নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। ফলে ফেমিনিস্ট ওকাম্পোকে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের আর দেখা হয়ে উঠেনি। রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পো সম্পর্ক আজো গবেষকদের জন্যে বিশেষ একটি বিষয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist