সিয়াম বিন আহমাদ
স্বপ্নের মায়াজাল
টিপটিপ বৃষ্টি সারাদিন। কেমন যেন শিশির পড়ার শব্দ। এখনই সাঁঝ নেমে পড়বে। গুড়–ম গুড়–ম মেঘের বোল। দোতলা বাসটা ক্যাম্পাস গেটে এসে থামল। নেমে পড়লাম আমরা। বাম হাতটা দিয়ে খুব শক্ত করে মায়ার ডান হাত ধরেছি। সবটুকু প্রণয় যেন এই মুঠোতে আঁকা। আমরা দৌঁড়ে এসে যাত্রী ছাউনিতে বসলাম। আমি ভেজা হাতটি দিয়ে সারা শরীরে বৃষ্টি ভরাচ্ছি আর ওদিক থেকে রাগান্বিত কণ্ঠ-
এখানে নামলে কেন? হলের সামনে নামলেই তোমার আর ভিজতে হতো না।
মায়ার শক্ত কথাগুলো আমার হৃদয়ে আঁচড় কেটে যায়। পরশ বুলিয়ে দেয় নরম সুখের। তাই আমি কথা বলি না। মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে হা করে শুনি সব। মায়া যখন আরো জোর দিয়ে বলে-
কী হলো, আমি কিছু বলেছি তোমাকে?
দৈবাৎ চমকে গিয়ে,
হ্যাঁ শুনছি তো, বলো তুমি...
মায়া এবার মুচকি হাসি টানে। সে আমাকে খুব বুঝতে পারে। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ। একটু পরে মায়ার বিরক্তি-
আচ্ছা তুমি এই বৃষ্টিতে এখানে কী করতে চাচ্ছ, শুনি?
বৃষ্টি তো, কী করব তুমিই বলো?
ও... এখন এই কথা, তোমাকে এখানে নামতে কে বলেছিল?
আমি খানিক থেমে যাই। কোনো উপায়ান্ত না পেয়ে কবিতার ঢঙে-
ওখানে নামলে তোমাকে বেশিক্ষণ দেখতে পারতাম না।
মায়া এবার ভ্রুকুটি করে ঠোঁট বাঁকায়-
ও তাই বুঝি?
হুম।
মায়া একটি আঙুল মুখের কাছে টেনে ঝগড়াটে মেয়েদের মতো-
এত ঢং কইরেন না স্যার।
কথাটা শুনে আমি একটু নড়ে বসি,
মানেটা কী?
এখন না, পরে বুঝবে।
না, আমি এখনই শুনব, বলো তুমি।
মায়া এবার হাসির ভণিতা মাখে।
না, কিচ্ছু না। এমনিতেই বলেছি।
ও... তাহলে তুমি বলবে না?
বললাম তো কিচ্ছু না। আচ্ছা চলো, আমরা বৃষ্টিতে ভিজি।
আমি বুঝতে পারি মায়া বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। আমিও নীরবতা টেনে বুঝাতে চাই অভিমানের পরাগ। আমার চেহারায় রাগের ছাপ অতটা প্রগাঢ় হয়ে ফোটে ওঠে না। এক-আধটু চিন্তিত মনে হয় মাত্র। মায়ার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে-
বলেছিলে না বৃষ্টিতে ভিজবে চলো ভিজি।
ওই রাগী মুখখানি বৃষ্টিতে ভিজিয়েই কী লাভ? যদি তাতে একফোঁটা হাসিই না ফোটে।
আমি আবার রাগের ভণিতা মাখি-
তুমি বলেছিলে তাই বললাম। এখন তোমার ইচ্ছে।
না, তোমার শরীর ভালো না। এইতো কদিন হলো বিছানা থেকে ওঠলে। এখন একটু ভিজলেই আবার ঠা-া-জ্বর চড়ে বসবে। আমি ঢের জানি তোমাকে।
আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না আপনার।
ও... তাই তো, আপনাকে নিয়ে ভাবার তো আরো অনেকেই আছে।
‘আপনি’ ‘তুমি’ সম্বোধন নিয়ে আজও আমাদের খুনসুটি লেগেই থাকে। আমাদের দুজনের একই সেশন। আমি পরিসংখ্যানে আর মায়া ফোকলোর স্টাডিজে। সেশন এক হলেও পরিসংখ্যানে খুব জট। আর ওদের একদম জট নেই। এই তফাৎ। রাগের সময় আমাদের থেকে ‘তুমি’ শব্দটা যেন অজানা ডায়েরিতে লুকিয়ে পড়ে।
বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমে আসে। আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি মাসুমের ফোন। এই দিকটা না ভেবেই বলে বসি-
তুমি পৌঁছে অবশ্যই একটা ফোন দেবে কিন্তু।
কথাটা শুনা মাত্রই একগুচ্ছ রাগ নেমে মায়ার লাল টুকটুকে বদনখানি নিমিষেই ফ্যাকাশে করে দেয়। মায়া তবুও কিছু বলে না। শপিং ব্যাগটা হাতে নিয়েই মুহূর্তের মধ্যে আমার আড়াল হয়ে যায়।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। বৃষ্টিরাতে একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসে না আমার। মায়াকে ফোন দিই। মায়া ফোনটা রিসিভ করে না। আমি এপাশ-ওপাশ করতে থাকি।
আজকাল সবটুকু ভাবনা শুধু মায়াকে ঘিরে। বেলা-অবেলায় মায়াকে নিয়ে কল্পনার রং মাখি। হৃদয় নিকুঞ্জ সজ্জিত হয় ওর আবির্ভাবে। নিজের ভেতরের পরিবর্তনটা খুব উপলব্ধি হয়। কত পাল্টে গেছি সেই আমি! ভুলে গেছি সকাল-বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকা। সন্ধ্যাবেলা বটতলায় গানের আসরেও যাওয়া হয় না ইদানীং! মাঝরাতে খোলা মাঠে আগের মতো সিগারেটের আসর বসে কি না, তারও খোঁজ রাখি না।
এমন ভাবতে ভাবতে একসময় তন্দ্রায় ডুবে যাই। মায়ার ফোন আসে। দু’চোখ মলে ফোনটা রিসিভ করি। ওপাশ থেকে সুরের পরাগ ভেসে আসে-
‘দেখতো ঘড়িতে ক’টা বাজে?
আমি বাচ্চা ছেলেদের মতো উত্তর দিই-
সাড়ে তিনটা
এত রাতে কি কেউ কাউকে ফোন দেয়? সে যাক, তো কী জন্য ফোন দিয়েছ শুনি?
এমনিতেই, তোমাকে খুব বেশি মনে পড়ছিল তাই।
মায়া এবার একটু ঢঙ করে-
আমাকে এত মনে করতে হবে না তোমার। বুঝলে? এখন লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়।
আমি আবদার মাখি-
আর একটু কথা বলো না, ঘুমোব তো।
কী কথা বলব শুনি? তুমি বলে দাও তারপর আমি বলছি।
আচ্ছা, তোমার কথা বলতে হবে না, যাও যাও...
মায়া একফোঁটা হাসি ভরিয়ে-
আচ্ছা, এত রাতে আমি কোথায় যাব শুনি? তারপর আবার বৃষ্টির রাত। কে দরজা খুলবে এই রাতে?
আমার বড্ড রাগ চেপে বসে-
আমার সঙ্গে মজা করা হচ্ছে, তাই না?
এতক্ষণে মায়ার ঘুমের ঘোরটা কেটে যায়। দুজনে কথা বলতে বলতে অবনীতে নেমে পড়ে তন্ময় ঊষা। কাঁঠাল ফুলের সুবাসে আরম্ভ হয় নতুন আরেকটা দিন।
ছ’মাস পর...
দিনগুলো কেটে গেল আপন গতিতে। স্মৃতি আজ হয়ে গেল স্বার্থপর। কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সুখের ডায়েরি থেকে মুছে গেল অতীত স্মৃতি। শুধু হারিয়ে যায়নি বেদনার কলরব।
মায়া ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছে। শুনেছি আজ কারো ঘরের প্রদীপ প্রহরী সেজেছে। দুই মাস আগে একবার ফোন করেছিল। জানতে চেয়েছিল- কেমন আছি? কতদিন লাগবে অনার্স শেষ হতে?
তারপর বলে গেল অনর্গল। একটা বোবা মানুষের মতো আমি শুনে গেলাম-
অত টেনশন করো না তুমি। খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যাবে। তারপর সুন্দর একটা জব হলে, লাল টুকটুকে একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও। ও, তুমি তো হলের খাবার তেমন খেতে পারতে না। আমি থাকতে মাঝেমধ্যে রান্না করে পাঠাতাম। হয়তো এখন খুব কষ্ট হয় তোমার। তবুও সময় করে খেয়ে নিও। আর শোনো, আমি খুব ভালোই আছি। মামুন একদমই চায় না আমি কোনো ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। তাই ইচ্ছে করেও তোমাকে ফোন দিতে পারিনি। কিছু দিনের মধ্যেই আমরা কাতার যাচ্ছি। জানি না কবে ফিরব। তুমি ভালো থেকো।
কথাগুলো শুনে ইচ্ছে হচ্ছিল, চিৎকার করে কাঁদি, পারিনি। আমাদের মতো বেকার যুবকদের চিৎকার করে কাঁদার স্বাধীনতাটুকুও নেই। আমার জমিয়ে রাখা নীরর ব্যথা মোমের মতো গলে পড়েছে। স্মৃতিগুলো আমাকে স্থির থাকতে দেয়নি। সান্ত¡নার বুকে একটু মাথাটা রাখতে পারিনি। কত স্বপ্ন বুনেছিলাম এই মায়াকে নিয়ে। আমরা ঘর বাঁধব। ছোট্ট একটা সংসার হবে আমাদের। স্বপ্নগুলো নিমিষেই নিকুচি হয়ে গেল। অপমৃত্যু হলো কল্পনাতীতের। ওই স্মৃতিগুলো আমাকে জ্বালায় তিল তিল করে। আমি জ্বলি। সেশন জটের আগুনে জ্বলে পুড়ে আজ তামাটে হয়ে গেল একটা জীবন।
"