কামাল সিদ্দিকী
বীরাঙ্গনার ক্যানভাস
রাজাকার কন্যা। সাদত আল মাহমুদের উপন্যাস। যা ট্রাজেডি উপন্যাস হিসাবে বাংলাসাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছে। শেক্সপিয়র তার রচনায় ট্রাজেডিকে যে মাপকাঠিতে আনতে সক্ষম হয়েছেন, লেখক হয়তো ততটা ট্রাজিক ড্রামা তৈরি করতে পারেননি। তবে তার প্রচেষ্টা পাঠককে নতুন সময়ের মুখোমুখি করেছে। নাম থেকেই অনেকটা স্পষ্ট হয় উপন্যাসের বিষয়বস্তু। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের চরম বিরোধিতাকারীর আত্মজকে নিয়েই আবর্তিত হয়েছে। প্রথমেই লেখক তার ক্যানভাসে নিয়ে এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিশাল পটভূমি। সেখান থেকে তিনি ধীরে ধীরে বের করেছেন নানা রং এবং বর্ণের কিচ্ছা। প্রথমে তিনি যে কথাটি বলে আমাদেরকে নাড়া দিয়েছেন সে কথাটি ঠিক এমনভাবে কজন লেখক বলেছেন, তা জানতে গেলে অনেক পরিসংখ্যান নিতে হবে। সহজ কথা তিনি সহজভাবে বলার জন্য কলম ধরেছেন।
উপন্যাসের কাহিনিতে আমাদের গর্বের মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে সর্বস্ব হারানো এক নারীর গর্বের কথা। যুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন রাজাকারের কন্যা। পিতা রাজাকার হওয়ার কারণে তাদের বাড়িতে এসেছে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের সঙ্গে পিতার দহরম মহরম তিনি দেখেছেন। দেখেছেন কিভাবে স্বাধীনতাপ্রিয় জাতির সোনার ছেলেদের ধরিয়ে বাবা পাকিস্তানের প্রসাদ লাভে মগ্ন। বাবা রাজাকারের কাছে পাকিস্তানই ছিল প্রথম এবং সর্বশেষ। তখন কেবলই কৈশর পেরিয়ে আসা এক উচ্ছল তরুণি। তবে দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের চাওয়ার সঙ্গে তার অবচেতন মনে এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে ভালোবাসা ছিল মুক্তস্বাধীন সোনার বাংলার। তবে নিজের বাড়িতে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ নেই। পাড়ার সমবয়সীদের সঙ্গেও আলাপের সুযোগ নেই। পাড়ার যারা সমবয়সী তারা পাকিস্তানি হানাদার আর রাজাকারদের ভয়ে আগেই গা ছাড়া। এমন সময়ে তার সামনে হাজির হলো তিন মুক্তিযোদ্ধা। বাবা তাদের পথ ভুলিয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে এসেছে। আনার সময়ে সে খবর দিয়ে এসেছে তার প্রভুদের। বেশ যতেœ আদরে তিন মুক্তিযোদ্ধাকে খাবারের আয়োজন চলছে। পাকিস্তানিরা আসা পর্যন্ত যেকোনোভাবেই হোক এদের আটকাতে হবে। এই ভাবনায় মেয়েকে সরিয়ে সে নিজে প্রহরায়। কিন্তু কিছু একটা করার প্রত্যয় তাহমিনার। অবশেষে সুযোগ এলো। বাবা একটু সরতেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে চোখ দুটি গুলিয়ে দিয়ে তিনি হুশিয়ার করে দিলেনÑ আপনারা তাড়াতাড়ি পালান, এটা রাজাকারের বাড়ি। বাবা পাকিস্তানিদের খবর দিতে গিয়েছেন। এলেই নির্ঘাৎ মৃত্যু। দামাল মুক্তিসেনার দল বের হয়ে ছুটলেন নিরাপদ এলাকার দিকে। এদিকে বাবা বাড়ি এসে তার পরিকল্পনা মাঠে মারা যাওয়াতে নিজ কন্যাকে তুলে দিলেন পাকিস্তানিদের হাতে। এরপর গল্প এগিয়েছে।
তাহমিনার ওপর পাশবিক নির্যাতন সমানে চলেছে। একদিন দেশ স্বাধীন হলে সেদিনের সেই তিন মুক্তিযোদ্ধাদের একজন আকবর তাহমিনার সন্ধান পান। জীবনের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে সেদিন তাহমিনাকে বউ হিসাবে ঘরে তুলে নেন। বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন দমকা হাওয়ায় তার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তাহমিনা কেবল ধর্ষিতা হয়নি, সে পেটে ধরে এনেছে এক অবৈধ পরিচয়হীন ভ্রুণকে। সেদিনের সে ভ্রƒণ তাদের সুখের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে সবকিছু। বিদীর্ণ আকাশ দিয়ে বের হয়ে আসে অশান্তির ঝড়। ফেলে যেতে হয় তাহমিনার সোনার সংসার। আশ্রয় মেলে অন্যখানে। কিন্তু আত্মমর্যাদাসম্পন্ন তাহমিনা জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গল্পকারের ভাষ্যে আমরা তাকে দেখতে পাই এক কলেজের আয়া হিসেবে। এরই মাঝে সেদিনের সেই ভ্রƒণ ভূমিষ্ট হয় পৃথিবীর বুকে। নতুন একটি প্রাণের স্পন্দনে কেঁপে ওঠে চেনা পৃথিবী। সর্বস্ব দিয়ে এবারে সেই ভ্রƒণকে মানুষের আবরণে সাজানোর পালা। একসময় সেটিও সম্ভব করে তাকে ডাক্তার বানানো হয়। বিলকিস চিকিৎসক হয়ে সমাজের অবহেলিতদের সেবা করার ব্রত নিলে তারও সংসার হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। গল্পের শেষে আমরা তার করুণ পরিণতি দেখতে পাই। আরিফ তাকে ভালোবেসেও সমাজের নামে তাকে প্রত্যাখ্যান করে।
উপন্যাসের এখানেই কারিশমা। লেখক এই অংশে এসে আমাদের নতুন করে জাগিয়ে দিতে চান। যতই মুখে আমরা মুক্তিযুদ্ধ এবং বীরাঙ্গনাদের নিয়ে আত্মতুষ্টির চেষ্টা করি না কেন, সেটি যে লোক দেখানো লেখক চাবুক মেরে আরো একবার বুঝিয়ে দিয়েছেন। সত্যিই আমরা আজও আমাদেরকে অতিক্রম করতে পারিনি। আমরা যেথায় মরি ঘুরে সেতো কভু যায় না দূরে। লেখক এই ট্রাজিক ক্লাইমেক্স তৈরি করে আমাদের যে ম্যাসেজটা দিলেন তার জন্য হয়তো পাঠক প্রস্তুত ছিল না। তবে এর চেয়ে আর ভালো কী হতে পারত? বইটি পড়া শেষে এই প্রশ্নটির মীমাংসার জন্য পাঠককে বারবার বইটি পড়তে হবে।
"