-কামাল সিদ্দিকী

  ১৬ মার্চ, ২০১৮

আক্রোশের সুন্দর ক্যানভাস

শামীম ফেরদৌসের নারীবিষয়ক নির্বাচিত প্রতিবেদন ‘তবুও কাটে না আঁধার’। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় লেখা প্রতিবেদনের সন্নিবেশ তিনি বই আকারে পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন। যুগে যুগে নারীর ওপর পুরুষের নিগৃহ এই বইয়ের পৃষ্ঠাজুড়ে বর্ণিত হয়েছে। লেখক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তার সমাধানের প্রয়াস চেয়েছেন, যা লক্ষণীয়।

বইটিতে নির্মম নারী নির্যাতনের কিছু ঘটনা তুলে ধরেছেন লেখক। লেখাগুলো নিঃসন্দেহে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া আলোচিত নারী নির্র্যাতনের ঘটনাগুলো আমাদের নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেবে। ২০১০ সালে ফারজানা কবীর রীতা, বিলাসী ও রজনীর সন্তানসহ আত্মহত্যার ঘটনা, ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের দু’চোখ অন্ধ করে দেওয়া, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখায় ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন, সালিসের কালো থাবায় হবিগঞ্জের ফেরদৌসীর আত্মহত্যা, ২০১৩ সালে রাজধানীর তোপখানা রোডে রীতু নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার, অভিনেত্রী মিতানূরের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে এই লেখাগুলোতে। প্রত্যেকটি ঘটনার সঙ্গে বিভিন্ন পেশার বিশিষ্ট নারীরা যেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তেমনি নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন।

আমরা সমাজে এখনো নারীকে পণ্য হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত। বলা যেতে পারে- এই আফিমে বুঁদ হয়েই আমরা নারীর বিভিন্ন কর্মকা- বিবেচনা করে থাকি। যেকোনো অপরাধের দায় নারীর, এই বিশ্বাস থেকেই আমরা এখনো তাদেরকে বিচার করি। বিচারটি যে যথার্থ নয়, লেখক বেশ সাবলীল ভাষায় সে কথা বলেছেন। আর যা বলতে চেয়েছেন তাতে কোনো রাখঢাক নেই। ‘তবুও কাটে না আঁধার’ বইটিতে ১৬টি প্রতিবেদনের সংযোজন রয়েছে। যার প্রথমটি হচ্ছে ‘আত্মহত্যায় সমাধান নেই’ আর শেষটি হচ্ছে ‘সালিসের কালো থাবায় বিপর্যস্ত নারী জীবন’।

সমাজে যৌন নির্যাতনের শিকার নারী। আর তার দায়ও নারীর। প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই নারীদের ওপর সব দোষ ঢেলে দেবার মানসিকতায় সমৃদ্ধ এই পুরুষ সমাজ। তাই দেখা যায়, নারী নিগৃহীত হলেন, তিনি আবার দ-ও পেলেন। যদিও মাঝেমধ্যে পুরুষকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তবে দ-ের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি এক ধরনের শিথিলতা দেখতে পাওয়া যায়। পুরুষের দোষকে লঘু করে দেখার মানসিকতা থাকলেও নারীর প্রতি করুণা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। আমরা শরৎচন্দ্রের বিলাসী গল্পে এই চিত্র দেখতে পাই। মৃত্যুঞ্জয় দোষ করেছে বিলাসীর হাতে অন্ন গ্রহণ করে। সমাজ স্বভাবতই নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। একটি বিজাতীয় মেয়ের হাতে লুচি নয় বা অন্য কোনো ফলমূল নয়, একেবারে ভাতান্ন গ্রহণ করায় সমাজপতিদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তারা মৃত্যুঞ্জয়কে ঘরে আটকে, টেনে-হিচড়ে বিলাসীকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়। আর এই দেওয়ার মধ্যে নিজেদের প্রভুত্বর প্রমাণ করে। অথচ বিলাসীর উদারতা একজন মুমূর্ষ রোগীকে সেবা করার সে ত্যাগ কোনোভাবেই সমাজে মূল্যায়িত হয় না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারীর প্রতি এই আক্রোশের সুন্দর ক্যানভাস শামীম ফেরদৌসের ‘তবুও কাটে না আঁধার।’ তার লেখনি শক্তি থেকে এটা বেশ স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে এসে সমাজকে চাবুক মেরেছে। কিন্তু সমাধান সূত্র যাদের হাতে তারা কি পারবে সেই দায় কাঁধে তুলে আমাদের পৃথিবীকে নারীর বাসযোগ্য করে দিতে? আর কথায় নয়, কাজে সমমর্যাদা দিতে। লেখক সেই প্রত্যাশিত প্রত্যাশার কথা তার লেখনি দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়েছেন।

এক নিঃশ্বাসে পড়ে যাওয়ার মতো এই বইটি নিয়ে অনেক কিছুই আশা করা যেতে পারে। সমাজে নারীদেরকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করার যথেষ্ট উপাত্ত বইটিতে রয়েছে। প্রকাশনার ক্ষেত্রে এই বইটি হতে পারে অনেক তথ্যের আধার। ভরসা এতটুকু, একঘর আঁধার তাড়াতে একটি মোমবাতিই যথেষ্ট। শামীম সেই আঁধার তাড়াতে মোমবাতি নিয়েই হাজির হয়েছেন।

তবুও কাটে না আঁধার শামীম ফেরদৌস

প্রকাশনী : কারুবাক

প্রচ্ছদ : গোলাম কিবরিয়া

মূল্য : ২২০ টাকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist