পিন্টু রহমান

  ১৬ মার্চ, ২০১৮

সমকালীন গল্পসাহিত্য

গল্পের আয়ুষ্কাল আপাত-অনিঃশেষ! তার আভিজাত্যময় দেহ-সৌষ্ঠবে নিয়ত যুক্ত হচ্ছে ইতিহাস-ঐতিহ্য, বেদ-পুরাণ, রাজনীতি-সমাজনীতি-ধর্মনীতি তথা পার্থিব-অপার্থিব যাপনলিপি। কোনো লিপির মর্মার্থ পূর্ণাঙ্গভাবে আদৌও উপলব্ধি করা সম্ভব কি না, কে জানে! কেননা, মিশরীয় সভ্যতার চিত্রলিপির মতো প্রাচীন সভ্যতার অনেক নিদর্শনই এখন পর্যন্ত অপঠিত রয়ে গেছে! তবে পরিবেশ-প্রতিবেশ ভেদে যাপনের ধরণ যেহেতু ভিন্ন সেহেতু গল্প বদলে যাচ্ছে। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের নবীনতম শাখাটি ক্রমশ ফুল-ফসলে সমৃদ্ধ হয়েছে। সমৃদ্ধির বরণডালা পরিপূর্ণ করার মানসে এ শাখায় দৃঢ় পদক্ষেপে বিচরণ করেছেন- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেন চন্দ, সুবোধ ঘোষ, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবুল ফজল, আবুল মনসুর আহমদ, আবু ইসহাক, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস, জহির রায়হান, শহিদুল জহির, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, মহাশ্বেতা দেবী, সেলিনা হোসেন, জাকির তালুকদার, রফিকুর রশীদ, হরিপদ দত্ত, শাহাদুজ্জামান, হরিশঙ্কর জলদাসের মতো শক্তিমান গল্পকাররা। তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় প্রকার-প্রকরণ ও বিষয়-বৈচিত্র্যে নবতর রূপ পরিগ্রহ করেছে। সমৃদ্ধ হয়েছে, সামগ্রিক গল্পসাহিত্য।

উল্লেখ করা জরুরি, ‘ছোটগল্প’ শিরোনাম নিয়ে বিতর্কের সুরাহা হয়নি আজও। কেউ বলে গল্প, কেউ বলে অনুগল্প, কেউবা বড়গল্প নামে আখ্যায়িত করে। আমি বলি গল্প; গল্প বলাতেই স্বাচ্ছন্দ। গল্পপথের দীর্ঘ পরিসরেও আমরা একটা সার্বজনীন সংজ্ঞা হতে বঞ্চিত। চেষ্টা যে হয়নি তা নয়, অসংখ্য মনিষী আকার-আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের মানদ-ে গল্পকে নির্দিষ্টতা দিতে চেয়েছেন, এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সংজ্ঞাটি অধিক প্রচলিত। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ নিজেও কি তার নির্দেশিত সংজ্ঞা পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণ করেছেন! না, করেননি। উত্তরসূরী হিসেবে আমরা তাহলে কোন পথ অবলম্বন করব!

রবীন্দ্র-গল্পের মূল বিষয় প্রেম ও প্রকৃতি; যে প্রকৃতি ছবির মতো দৃশ্যমান করে তুলেছেন একান্তই তা আমাদের নিজস্ব; পূর্ববঙ্গের নদী-মাঠ-প্রান্তর। ‘স্বর্ণমৃগ’ শিরোনামের গল্পে উল্লেখ করেছেন- ‘মেঘমুক্ত আকাশে শরতের সূর্যকিরণ উৎসবের হাস্যের মতো ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, পক্কপ্রায় ধান্যক্ষেত্র থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, বর্ষাধৌত সতেজ তরুপল্লব নব শীতবায়ুতে সির সির করিয়া উঠিতেছে- এবং তসরের চায়নাকোট পরিয়া কাঁধে একটি পাকানো চাদর ঝুলাইয়া ছাতি মাথায় প্রত্যাগত পথিকেরা মাঠের পথ দিয়া ঘরের মুখে চলিয়াছে।’

‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে লিখেছেন- ‘পূর্বদিন বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আজ ক্ষান্তবর্ষণ প্রাতঃকালে মøান রৌদ্র ও খ- মেঘে মিলিয়া পরিপক্কপ্রায় আউশ ধানের ক্ষেত্রের উপর পর্যায়ক্রমে আপন আপন সুদীর্ঘ তুলি বুলাইয়া যাইতেছিল; সুবিস্তৃৃত শ্যাম চিত্রপট একবার আলোকের স্পর্শে উজ্জ্বল পা-ুবর্ণ ধারণ করিতেছিল আবার পরক্ষণেই ছায়াপ্রলেপে গাঢ় স্নিগ্ধতায় অঙ্কিত হইতেছিল। যখন সমস্ত আকাশরঙ্গভূমিতে মেঘ এবং রৌদ্র, দুইটি মাত্র অভিনেতা, আপন আপন অংশ অভিনয় করিতেছিল তখন নিম্নে সংসাররঙ্গভূমিতে কত স্থানে কত অভিনয় চলিতেছিল, তাহার আর সংখ্যা নাই।’

অন্যসব কারণ বাদ দিলেও শুধু প্রকৃতি বর্ণনার কৌশল ও প্রয়োগরীতি রপ্ত করতে একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে না এসে উপায় নেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রূপায়ন করেছেন সমাজের অন্ত্যজ ও নিম্নবর্গীয় শ্রেণির জীবনকথা! অসংখ্য কালোত্তীর্ণ গল্পের জনক তিনি। হরিশঙ্কর জলদাসের গল্পের আখ্যানে কড়ি-বর্গের মতো ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে জলপুত্রদের ছবি! তিনি নিজেও জলের সন্তান! ফলে বিশ্বাসযোগ্য মাত্রায় উঠে এসেছে জেলে সমাজের জীবনাচার। হাসান আজিজুল হক বাংলা গল্পসাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি। জীবনবাদী এ গল্পকারের গল্পে রাঢ় অঞ্চলের জীবন-প্রকৃতি ও ভাষার আঞ্চলিকতা বিশেষ মর্যাদায় বিধৃৃত হয়েছে। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ বাংলা গল্পের অমর সংযোজন। বিংশ শতাব্দীর শহুরে জীবন দ্বারা আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস প্রভাবিত। জাকির তালুকদারের গল্পে দেশি-বিদেশি মিথের প্রয়োগ প্রবলভাবে লক্ষণীয়। বিশেষত ইসলাম ধর্মীয় মিথের প্রতি বিশেষ অনুরাগ পরিলক্ষিত। সোমেন চন্দ ও হরিপদ দত্ত বাম রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত। শ্রমজীবী, প্রান্তিক জনগণ তাদের গল্পে আলোকিত। আবু ইসহাক, রফিকুর রশিদ মাটিবর্তী ধারার গল্পকার। জহির রায়হানের গল্পে প্রেম ও যুদ্ধ ফুল হয়ে ফুটে আছে। বাঙালির গৌরবময় অধ্যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেলিনা হোসেন অসংখ্য গল্প রচনা করেছেন। রম্যকথায় অপশক্তির স্বরূপ উন্মোচনে সচেষ্ট ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।

গল্পের প্রকরণ নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই। যে নামে বা ভাবে ভাগাভাগি করি না কেন, তা হবে সঙ্কীর্ণ। কোনো একটি গল্পকে প্রেমের গল্প হিসেবে নির্দিষ্ট করলে পরবর্তী প্রশ্ন হবে প্রেমের পরিণতি কী- মিলনাত্বক নাকি বিরহাত্বক! সহজ কথায় বলি, গল্প দু’রকম- গল্পময় গল্প ও গল্পহীন গল্প।

গল্পহীন গল্প লেখার প্রবণতা খুব বেশি দিনের না। গোষ্ঠীবদ্ধ বা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ক্ষীণ ধারাটি এগিয়ে চলেছে। এর ভবিষ্যত বিষয়ে শঙ্কিত আমি। গল্পে গল্প না থাকলে পাঠক তা পড়বে কেন! পাঠককে ধরে রাখতে একরৈখিক, বহুরৈখিক, সরলপাঠ নাকি জটিলপাঠ- হা, এ বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে, তবে গল্পকে গল্পহীন করার ঘোর বিরোধী আমি। কমলকুমারীয় জটিল গদ্যভাষা গল্পের শরীরে লেপ্টে দিয়ে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, শিমুল মাহমুদ, কারুজ্জামান জাহাঙ্গীর, মামুন হুসাইন, আবু হেনা মোস্তফা এনাম প্রমুখ গল্পকাররা আলাদা একটা ধারা তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন।

গল্প নিয়ে নিরীক্ষণের বিশেষ কিছু নেই; আমরা যা করি তা পরিবেশনের কৌশলমাত্র- এ কৌশল ছিল, আছে, আগামীতেও থাকবে। গল্প যেহেতু কালকে ধারণ করে সেহেতু কালগত বৈশিষ্ট্য থাকবেই। বিছিন্নভাবে হলেও দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় প্রচুর গল্প রচিত হয়েছে। গল্পের শরীরে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন শিল্পের মর্যাদা পেয়েছে। ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও তাদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস বিশেষ মহিমায় প্রকাশ পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে মহাশ্বেতা দেবীর নাম স্মরণীয়। পশ্চিমবঙ্গের মুন্ডা-সবর-সাঁওতাল উপজাতীকে বীরের মর্যাদায় আসীন করেছেন। গল্পের বড় ক্যানভাস তিনি।

এ সময়ের গল্পের দুর্বল দিক হলো, আপসকামিতা; লেখকদের আপসকামী মানসিকতার কারণে নাজুক গণতন্ত্র, ভঙ্গুর অর্থনীতি, সুদ-ঘুষ, খুন-গুমের মতো ঘটনা চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে তারা ব্যর্থ। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপক্ষে মুখ খুলতে নারাজ। লেখকদের দেউলিয়াত্বের চূড়ান্ত উদাহরণ এটি। গল্পসাহিত্যের দু’শো বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখি- দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে লেখকরা সাহসী ভূমিকা পালন করেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা না হয় বাদই দিলাম; নিকট অতীতে (নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন) লেখকের ভূমিকা ছিল ঈর্ষণীয়! স্বভাবতই আমরা এখন অস্থির সময়ের মুখোমুখি। দ্রুত গতিতে জীবনভাষ্য বদলে যাচ্ছে। গ্রামজীবনের পরিবর্তে ইট-কাঠ-পাথরের নাগরিক জীবন গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে। কৃষিভিত্তিক জীবনাচার আর আগের মতো নেই, কাজের সন্ধানে সবাই শহরমুখী। ফলে গল্পের বিষয় বদলে যাচ্ছে; বদলে যাচ্ছে পাত্র-পাত্রী এবং তাদের ভাষা। ভাষার আঞ্চলিকতা সমকালীন গল্পের অন্যতম বিশেষ দিক। আঞ্চলিকতা বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ভিন্ন মত থাকলেও এটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করি। চরিত্রদের মুখ দিয়ে ওইসব কথা বলাতে চেষ্টা করি; যা আলোচ্য সমাজে প্রচলিত। ফলে যা হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যের অনেক লোকায়ত এবং অপ্রচলিত শব্দ উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে; সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের গল্পসাহিত্য।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist