মাহবুবুল আলম মাসুদ
নিমকহালাল
ভাদ্রের এক ভরদুপুরে মায়া রাণী তাদের বাড়ির ছাদে উঠল। দুপুরটা সুনসান। কোথাও সাড়াশব্দ নেই। শুধু উঠোনের বড় আমগাছটার অজানা ডালে বসা ঘুঘুটার একটানা ঘু-ঘু ডাক শোনা যাচ্ছে। আমগাছের খানিকটা ছায়া পড়েছে ছাদের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে। মায়া রাণী সে ছায়াতেই মোড়া পেতে বসল।
চারদিকে ঝকঝকে রোদ। মায়া রাণী আকাশের দিকে তাকাল। আকাশটাও ঝকঝকে। এখান থেকে পুরো আকাশ দেখা যাচ্ছে। এত বড় আকাশের কোথাও কালো দাগ নেই। দেখে মনে হচ্ছে, আকাশটাতে কে যেন নীল রং ঢেলে দিয়েছে। ভুল করে এখানে-সেখানে কয়েক ফোঁটা শাদা রং-ও পড়ে গেছে। কিন্তু সে ভুলটাই এখন সবচেয়ে সঠিক বলে মনে হচ্ছে।
এই দত্তবাড়ির উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব তিন দিকেই খোলা প্রান্তর। আশেপাশে এরকম পাকা বাড়ি নেই, কাছাকাছি কোনো বাড়িঘরও নেই। পশ্চিম দিকের নদীটা কতকাল ধরে বয়ে যাচ্ছে কে জানে। ভাদ্রের এই শেষে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। পাড়ের কাশবন হেসে উঠেছে। ওপারের মাইলকে মাইল বিস্তৃত চর জেগে উঠেছে। সেখানে ফসল ফলাতে ব্যস্ত কৃষকরা। মালবোঝাই বিশাল-বিশাল নৌকা যাচ্ছে উজানে, ভাটিতে। গুন টেনে, পাল তুলে। নদীর পাড়ের বহু পুরনো বটগাছটা ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
এই ভর দুপুরে ছাদে মায়া রাণীর কোনো কাজ ছিল না। নিচে সংসারেরও কাজ নেই। একটু ভুল হলো। কাজ আছে কিন্তু তাকে করতে হয় না। মায়া রাণীর স্বামী এবং একমাত্র দেবর সকালে খেয়ে গঞ্জের দোকানে চলে যায়। ফিরে সেই রাতে। দুপুরের খাবার বিষ্ণু নিয়ে যায়। রান্নাবান্নার কাজটা বিষ্ণুর মা-ই করে। মায়া মন চাইলে সঙ্গে থাকে না-চাইলে থাকে না। তাতে কোনো সমস্যা হয় না। বিষ্ণুর মা মায়ার শাশুড়ির আমলের লোক।
দুপুরবেলায় দত্তবাড়িতে মানুষ তাই তিনজন। মায়া, বিষ্ণ ও বিষ্ণুর মা। মায়া নিঃসন্তান সে কথা নাইবা বললাম। শ্বশুর তো মায়ার বিয়ের পর পরই স্বর্গে গেছেন। শাশুড়ি যত দিন ছিলেন নিঃসন্তান মায়াকে তত দিন কিছু গঞ্জনা সইতে হয়েছে। এখন সে সমস্যা নেই। স্বামী এ নিয়ে কোনো কথাই বলেন না। দুঃখে নয়, সুখ বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এখন মায়া আর তার স্বামী মিলে দেবরকে বিয়ে দিয়ে ভবিষ্যতের উত্তরাধিকারের মুখ দেখার আশায় আছে।
দত্তবাড়ি এতটা সুনসান ছিল না। মায়া নিজেই তা দেখেছে। বছর পনেরো আগে মায়া যখন বউ হয়ে এ বাড়িতে এল তখনও অনেক লোকজন ছিল। দোকানের কর্মচারিই ছিল পাঁচ-ছয় জন। মায়ার দুই ননদের তখনো বিয়ে হয়নি। বিয়ের পরও এক ননদ জামাইসহ এখানেই ছিল অনেক দিন। এখন ব্যবসায় আগের মতো নেই। তা ছাড়া মায়ার স্বামী ইচ্ছে করেই ব্যবসায় কিছুটা গুটিয়ে ফেলেছেন। ব্যবসার টাকা দিয়ে ফসলি জমি কিনে রেখে দিয়েছেন।
মায়া রাণী একটা বই হাতে নিয়ে ছাদে এসেছে। তার বাপের বাড়িতে একটা পাঠশালা ছিল। তার কাকা রবিশঙ্কর প-িতের পাঠশালা। সেই পাঠশালায় এবং নিজে নিজে পড়ে বাংলাটা এখন সে ভালোই পড়তে পারে। তাই কখনো বই হাতে, কখনো বই ছাড়া ঘরের বাইরের এই সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে সে ছাদে চলে আসে। কখনো ভোরে কেউ না জাগার আগে, কখনো ভরদুপুরে, কখনো সন্ধ্যায়, কখনো রাতের তারা ভরা আকাশ দেখতে।
হাতের বইটা মায়াকে টানছিল না। তাই বই থেকে চোখ বারবার সরে যাচ্ছিল এদিকে-সেদিকে। হঠাৎ তার চোখ গেল নদীর পাড়ের বটগাছটার দিকে। আট-দশ জন ভিনদেশির মতো লোক মাঝারি সাইজের একটা নৌকা থেকে নামল। তীরে উঠে তারা বটগাছটার ছায়ায় বসল।
মায়া রাণী বইটা বন্ধ করে হাতে নিয়ে নিচে নেমে গেল।
নিচে এসে রান্নাঘরে উঁকি দিল মায়া। বিষ্ণু তার মায়ের কাজে সাহায্য করছে। বসে বেগুন কুটছে।
মায়া বলল, কিরে বিষ্ণু, দিন-দিন তুই যে মেয়ে-মানুষ হয়ে যাচ্ছিস। সারা দিন রান্নাঘরেই বসে থাকিস। তোকে বিয়ে করাব কী করে? তোর বউ তো তোকে ফেলে পালিয়ে যাবে।
বিষ্ণু লজ্জায় লাল হয়ে নিচু মাথা আরো নিচু করে।
মায়া বলল, এদিকে আয়, তোকে একটা কাজ দিই।
বিষ্ণু বেগুন-বটি ফেলে বাইরে এসে দাঁড়াল।
মায়া বলল, মনোযোগ দিয়ে শোন। নদীর পাড়ের বটগাছটার নিচে কিছু ভিনদেশি লোক বসে আছে। তুই গিয়ে বলবিÑ মাসীমা আপনাদের ডাল-ভাত খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পারবি না?
পারব, মাসীমা।
তা হলে দৌড় দে। বিষ্ণু সত্যিই এক দৌড় দিল।
বটগাছের নিচে লোক মোট সাতজন। মাসীমার কথা ঠিকই। এরা কেউ এ অঞ্চলের না। কাজের খোঁজে এসেছে নিশ্চয়ই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা খুব ক্ষুধার্ত। মাসীমার কত মায়া! সবাই এলোমেলো বসে আছে। মাথায় গামছা বাঁধা একটা খাটোমতো লোক বটগাছে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। বিষ্ণুর পায়ের শব্দেই চোখ মেলল। বলল, কী চাও খোকা?
বিষ্ণু বলল, কিছু চাই না। মাসীমা আপনাদেরকে ডাল-ভাত খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
কে তোমার মাসীমা?
ওই যে, ওই বাড়ির গিন্নি। আঙুল তুলে সে বাড়িটা দেখাল।
তুমি ওই বাড়ির কে?
আমি ওই দত্তবাড়িতে কাজ করি।
তোমার মাসীমাকে গিয়ে বলো, আমরা দুপুরে খাই না।
আচ্ছা, বলে বিষ্ণু চলে আসছিল।
কিছুদূর এগোতেই হঠাৎ লোকটি ডাকল, এই খোকা, শোনো!
বিষ্ণু আবার ফিরে গেল।
লোকটি বলল, তোমার নাম কী?
বিষ্ণু।
বিষ্ণু শোনো, তোমার মাসীমাকে গিয়ে বলবে তার নিমন্ত্রণ আমরা গ্রহণ করেছি। কিন্তু ডালে যেন নিমক দেওয়া না হয়। ডালটা নিমক ছাড়া রান্না করতে বলবে।
আচ্ছা।
বিষ্ণু ফিরে এল মায়ার কাছে।
মায়া শুনে বলল, তুই গিয়ে বল ডাল রান্না হয়ে গেছে।
বিষ্ণু আবার গেল ভিনদেশিদের কাছে সেই বটগাছের তলায়।
ডাল রান্নার খবর শুনে সেই বটগাছে ঠ্যাস দিয়ে বসে থাকা লোকটি বলল, রান্না যখন হয়েই গেছে তো কী আর করা। নিয়ে এসো।
বিষ্ণু ফিরে এল।
ডাল রান্না করাই ছিল। ভাতও হয়ে গেল মুহূর্তেই। বড় একটা গামলায় ভাত, আর একটা মাঝারি সাইজের ডেকচিতে ডাল বাড়ল বিষ্ণুর মা। গামলা আর ডেকচি বড় একটা গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে বিষ্ণুর মাথায় নিজ হাতে তুলে দিল মায়া।
বিষ্ণু খাবার নিয়ে বটতলায় চলে গেল।
ভিনদেশিরা সত্যিই খুব ক্ষুধার্ত ছিল। খাবার দেখে তারা খুবই খুশি হলো। একজন বলল, কাঁচালঙ্কাও আছে দেখা যায়!
তারা সবাই পেট পুরে খেল।
খাওয়া শেষে বিষ্ণু যখন বাসন নিয়ে ফিরছিল তখন মাথায় গামছা বাধা সেই লোকটি বলল, বিষ্ণু, একটু দাঁড়াও।
বিষ্ণু দাঁড়াল। লোকটি বসা থেকে উঠে বলল, তোমার সঙ্গে আমাকেও নিয়ে চলো। তোমার মাসীমাকে দুটো কথা বলে আসি। এত কষ্ট করে তিনি আমাদের খাওয়ালেন।
তারা হাঁটতে লাগল। সামনে বিষ্ণু, পেছনে সেই বেটেখাটো লোকটি।
বাড়ি পৌঁছে বিষ্ণু লোকটিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। মায়ার কাছে গিয়ে বলল, মাসীমা, ভিনদেশিদের একজন আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়।
মায়া বলল, আমার সঙ্গে আবার কী কথা!
কী জানি!
চল দেখি।
মায়া বাড়ির কাছে গিয়ে আড়ালে দাঁড়াল। বিষ্ণু বাইরে গিয়ে লোকটিকে বলল, মাসীমা এসেছেন। কী বলবেন বলেন।
লোকটি কোনো রকম ভূমিকা ছাড়া বলল, মা, আমরা ডাকাত ঠিকই কিন্তু নিমকহারাম নই। আপনার নিমক খেয়েছি নিমকহারামি করব না। আপনার বাড়িতে ডাকাতি করতেই এসেছিলাম। চলে যাচ্ছি। আর বাড়িতে একটা চিহ্ন রেখে যাচ্ছি। এই বাড়িতে কোনো দিন ডাকাতি হবে না।
মায়া আড়ালে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। ছাদ থেকে দেখেই সে বুঝেছিল, এটা ডাকাত দলই হবে। এটাও জানত, ডাকাতরা আর যা-ই হোক নিমকহারাম নয়। তাই ডাল-ভাত খাওয়ানোর নামে নিমক খাইয়ে দিয়েছেন।
"