সালাম কারিগর
চারদিকে অন্ধকার
বেশ কিছুদিন ধরে সায়মা মিলনকে এড়িয়ে চলছে। কিন্তু কেন? অনেক চেষ্টা করেও মিলন কারণ উদ্ধার করতে পারেনি। তবে কি সায়মা আমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে চায় না? তা-ই বা হবে কেন? ঘর বাঁধার স্বপ্ন সায়মাই আমাকে দেখিয়েছে। ঘর বাঁধায় প্রেম তো শেষ হয়ে যায় না। এর মাধ্যমেই প্রেম চিরদিন বেঁচে থাকে। সায়মার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেন সে আমাকে এড়িয়ে চলছে! তার আচরণে কেন এত পরিবর্তন! বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ার পরও দেখিনি তাকে অহমিকা করতে। তবে হঠাৎ কেন তার এই পরিবর্তন?
মনের আকাশে উদিত হওয়া এসব উত্তরবিহীন প্রশ্নগুলো মিলনকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যতদিন যায়, অস্থিরতা তত বাড়তে থাকে। সায়মা মিলনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না, তা দিনের আলোর মতোই এখন স্পষ্ট। তার মনের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে ঝড়ে তার স্বপ্নগুলো ভেঙে যাচ্ছে। অমাবস্যার আঁধারে স্বপ্নগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। বোবা বৃক্ষের মতো সে সবকিছু নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। মিলনের হৃদয়ের সবটুকু জায়গা দখল করে আছে সায়মার প্রতিচ্ছবি। সেই প্রতিচ্ছবি হৃদয়ের প্রতিটি রক্ত কণিকায় একাকার হয়ে মিশে আছে। সে ছবি মুছে ফেলার প্রয়াস মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। তাই মিলন ঝুঁকি নিতে চায় না। ঠাÐা মাথায় সবকিছু মোকাবিলা করতে চায়।
মিলনও ধীরে ধীরে কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। তাকে দেখে বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ ও বস প্রায়ই বলেÑ আপনার শরীর কি খারাপ? কোনো সমস্যা হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর সে কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু সায়মার প্রভাব অফিসের কাজকর্মের ওপর পড়েছে, তা কোনোভাবেই সামলাতে পারছে না। ইদানিং সায়মার মোবাইলটা প্রায়ই বন্ধ থাকে। ঠিকমতো কথাও হয় না। সায়মার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য সে উদগ্রীব থাকে। বারবার কল করার পরও সায়মা কল রিসিভ করে না। জলের মাছ ডাঙায় ওঠালে যেরকম অবস্থা হয়, ঠিক সেরকম অবস্থাই মিলনের। রাতে ঠিকমতো ঘুমও হয় না। ঘুমাতে যাওয়ার সময় শুয়ে শুয়ে অনেক কিছু ভাবতে থাকে। একদিন ঠিক এমন সময় মিলনের মোবাইলে কল আসে। এত রাতে কল আসায় সে খুব বিরক্ত হয়। রিংটোন বন্ধ করতে মোবাইলটি হাতে তুলে নেয়। স্ক্রিনে সায়মার নামটা চোখে পড়তেই মনের মধ্যে একটা আনন্দের বজ্রপাত ঘটে। সায়মাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভালোবাসা জড়িত কণ্ঠে বলতে থাকে, ‘সায়মা, তোমার কী হয়েছে? আমাকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছ? তোমার বিরহ আমি সহ্য করতে পারি না। বোঝাতে পারব না আমি কত কষ্টে বেঁচে আছি। বলো, আমার অপরাধ কী?’
: তোমার কোনো অপরাধ নেই। আর যদি থাকে সে তো আমার।
: পাগলামি করো না। কী হয়েছে তোমার?
: আমার একটা কথা বিশ্বাস করবে?
: তোমার কোন কথাটি বিশ্বাস করিনি!
: শুধু একটা কথা মনে রাখবে। তোমার কষ্ট হোকÑ তা কখনো চাইব না।
তারপর সায়মার কণ্ঠে কান্নার আওয়াজ। মিলন বারবার কারণ জানতে চাইলেও সায়মা উত্তর দেয় না। সে বুঝতে পারে সায়মা কল কেটে দিয়েছে। সেদিন আর কথা হয়নি। অভিমান ভুলে মিলন সিদ্ধান্ত নেয়, আগামীকালই সায়মার অফিসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করবে।
পরদিন মিলন সায়মার অফিসের উদ্দেশে রওনা দেয়। পথেই সায়মার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মিলনের কাছে মনে হলোÑ আকাশের চাঁদ বুঝি তার পথ আগলে রেখেছে। ধানমন্ডি লেকে গিয়ে তারা বেঞ্চে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সায়মা বলতে শুরু করেÑ মিলন, তুমি তো জানো অনেকদিন আগেই আমার মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকে চলে গেছে। বাবাও মৃত্যুর পথযাত্রী। তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। মায়ের অভাব কখনো বুঝতে দেননি। তবে তিনি কখনো চাননি, আমার কোনো ছেলে বন্ধু থাকুক। তোমার কথা যেদিন বাবাকে জানিয়েছিলাম সেদিন বাবা আমাকে বলেছিলেনÑ মা, এ অভিশপ্ত জীবনে অন্যকে কেন জড়াতে চাস? বাবা এ কথাগুলো বলার সময় খুব কেঁদেছিলেন। সেদিনই প্রথম জানতে পারলাম, আমার মা এইডস রোগে মারা যান। আমি চমকে উঠি! একটা অজানা আতঙ্ক আমার মনে বাসা বাঁধে। আমি বøাড পরীক্ষার জন্য ডাক্তার দেখাই। রিপোর্টে এইচআইভি পজেটিভ বয়ে বেড়াচ্ছি। মিলনের হাত জড়িয়ে ধরে অশ্রæসিক্ত নয়নে সায়মা বলে, আমাকে মাফ করে দাও। আমার অভিশপ্ত জীবনে তোমাকে জড়াতে চাই না। আমি যে তোমাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালবাসি! ভীষণ! তার কথাগুলো শুনে মিলনের শরীর হিম হয়ে আসে। ভর দুপুরেও সে চারদিকে অন্ধকার দেখে। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। সে বুঝতে পারে না- এখন সে কী করবে?
"