জা কি র উ স মা ন

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

জীবনের ছায়াচিত্র

তার ছোটবেলাকার নদী আর শহর; ইয়াংসির ও সিংকিয়াং। এই যে খরস্রোতা ইয়াংসির আর মনোরম সুন্দর ছোট্ট শহর সিংকিয়াংয়ের সংস্পর্শ, তা তার জীবনে ঐশ্বর্যময় এক আশ্চর্য জীবনবোধের পাহাড় গড়ে দিয়েছিল। বাবার মুখে শোনা নানা হৃদয়হরা গল্প আর রূপকথা, তার সাহিত্যপ্রীতির প্রতি মায়ের অকুণ্ঠ অনুরাগ- এসব তাকে জীবনের উচ্চতায় তুলে দিয়েছিল। পার্ল এস বাক তাই মানুষের শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। লিখেছিলেন কালজয়ী সব বই। ‘গুড আর্থ’ তা-ই হয়ে ওঠে তার কথাসাহিত্যের প্রামাণিক শক্তির মহড়া। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে তাই তার অন্যসব সৃষ্টির মতোই এই বই নিয়েও এত আলোড়ন।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। পার্ল এক দেশে জন্মেন, আরেক দেশে বেড়ে ওঠেন। জীবনের শুরুর সেই সতেরোটি বছর তাকে তৈরি হতে সাহায্য করেছিল। ধর্ম-প্রচারের উদ্দেশ্যে বাবা-মায়ের আসা-দেশ চীন থেকে, একটু বড়বেলায় যুক্তরাষ্ট্রে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অনেক অভিজ্ঞতা, কল্পনা-জগৎ আর সৃষ্টির সম্ভার। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ওয়াঙ লাঙ, অভাবে অসীম দারিদ্র্যে ও দুর্ভিক্ষেও তাকে হয়ে উঠতে হয় কীর্তিমান শক্তিমত্ত সুপুরুষ; যে কর্মে প্রজ্ঞায় দৃঢ়তায় সৎ। যার কাছে সবকিছুর চেয়ে মহীয়ান ‘মাটি’। এই মাটি আঁকড়ে কামড়ে ওয়াঙ লাঙ চেয়ে থাকেন জীবনে একদিন সুদিন আসবেই। সত্যিই এই মাটিই একদিন ওয়াঙ লাঙকে বিপুল ঐশ্বর্য দিয়েছিল। ওয়াঙ লাঙ ‘বিকেলবেলার ফকির’ থেকে ‘সকালবেলার ধনী’ হয়ে উঠেছিলেন।

অভাব ও ঐশ্বর্য কোনোটাই ওয়াঙ লাঙকে সৎ থাকতে দেয়নি। ওয়াঙ হয়ে ওঠেন অনুতপ্ত ও দ্বা›িদ্বক এক মানুষ, যে মাটির লোভী, অপচয়কারী। যে অনাহারী ও ভোজনলিপ্সু। যে সৎ, পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল। বাবার প্রতি কর্তব্যপরায়ণ। স্ত্রীর প্রতি ‘তৃপ্ত’। এই যে অভাব অথবা ঐশ্বর্য দুটোই তো লোভ জাগায়। অভাব যেমন ভাত দেয় না। চুরি করায়। ধনীকে শত্রæ করে তোলে। ঐশ্বর্যও কম কইÑ ভাত দেয় ঠিকই, সঙ্গে দেয় নেশাÑ মদের, নারীর, আরও টাকার, আরও আরও মাটির, এবং প্রাসাদের এবং বাগানের। এইখানেও তার শত্রæ আছেÑসে আরেকজন ঐশ্বর্যবানকে তার শত্রæ করে তোলে। যাকে তার অতিক্রম করা চাই। তারচেয়ে বেশি ঐশ্বর্যের মালিক তাকে হতেই হবে। এই লোভ তাকে, এই হতদরিদ্র থেকে অতিধনীকে, অন্ধ করে দেয়। ওয়াঙ মানবজীবনের এই চিরায়ত কদর্য সত্যের প্রতিনিধি।

ওয়াঙের স্ত্রী ওলান; জমিদারবাড়ির এই দাসীকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিলেন তিনি। ওলানের স্বামীভক্তি ও স্বামীবন্দনা অসীম। সারাজীবনে কতবার কথা বলেছেন ওলান, তা প্রায় হিসাব করে বলে ফেলা যাবে। ওলান স্বামী-সংসার-সন্তানসন্ততি নতুন বাচ্চা দেওয়া মা-মুরগির মতো আগলে রেখেছিলেন পুরোটা জীবন। ওলানের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। প্রাপ্তি নেই। প্রাপ্তির আকাক্সক্ষাও নেই। স্বামীর একটু আদর, একটু অহিংস দৃষ্টিই কেবল তার সমগ্র-জীবনের প্রার্থনা ছিল, তা-ও কখনই ওরকম করে পাননি। ওলান প্রতিবাদ করেন না। ওলানের কথা-কওয়া নেই। মত ও অমত নেই। ওলানের কেবল দিতেই জানা আছে, নিতে নেই। ওলান কি তাই অবহেলিত নিষ্পেষিত যন্ত্রণাদগ্ধ ও ক্লিষ্ট? জীবনের এই প্রতিবাদহীনতা, কথা না-কওয়া, মত-অমত না দেওয়াই কি তবে ওলানের নিগ্রহের কারণ? এ-ই হয়তো সত্যÑ মানুষ শক্তেরই ভক্ত, নরমেরই যম! ওলান শক্ত নয় বলেই কোণঠাসা। ওলান নরম বলেই নিগৃহীত।

একদিন ওলানের প্রতি ওয়াঙের মোহ ফুরিয়ে যায়। অর্থের শক্তিতে ভর করে ঘরে আসে নতুন নারী পদ্ম। ওলান তবুও সহ্য করে। কথা কয় না। খানিক প্রতিবাদ কেবল কাজে আর আচরণে, নিঃশব্দে আর নীরব অভিমানে। তবুও কি পুরুষ ওয়াঙ এতটুকু টলে? টলে না। গলে? তা-ও না। শেষ-জীবনে আবার নারী, আরও নতুন আরও আনকোরা; নাম তার কলি। একদিকে একাত্তর বছরের ওয়াঙ, আর-এক দিকে ষোলো বছরের কলি। কী অসম! তবুও নারী মুঠোবন্দিÑ অর্থের কাছেও, পৌরুষের কাছেও। এ-ই কি মানবমানবীর প্রকৃতিগত নাকি কেবলই লোভ আর মোহের অন্ধ ঘোর! যেই জমিদারবাড়ির দাসী বিয়ে করেছিলেন ওয়াঙ, বৈভব ও ঐশ্বর্য খুইয়ে সেই অট্টালিকা একদিন রঙ ও জৌলুস হারিয়ে দীন-দারিদ্র্যে নিঃশেষিত। ভাগ্যের খেল, অর্থেবিত্তে সম্পদের পাহাড় জমানো ওয়াঙকে একদিন সৌভাগ্য নিয়ে যায় সেই বাড়িতেই, যে বাড়িতে একদিন সে ছিল অভ্যাগত অনাহূত ও উপদ্রব, আজ সে তার মালিক। তার রাজা। আগের সেই মালিক সেই জমিদার আজ দারিদ্র্যে অভাবে পলেস্তারা খসে যাওয়া দেয়ালের মতো শ্রীহীন মলিন ও রঙহারা। জমিদারের অভাবের সুযোগ ওয়াঙের সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দেয়; দরিদ্র ভৃত্য-দাসীপতি ওয়াঙই মালিক আর ধনী প্রতাপ ও প্রভাবশালী মালিক জমিদারই যেন ভৃত্য।

প্রথম-নতুন যেদিন পুরনো হয়, সেদিন আসে দ্বিতীয়-নতুন। দ্বিতীয়-নতুন যেদিন পুরনো হয় সেদিন আসে তৃতীয়-নতুন। তৃতীয়-নতুনের বিদায়ের দিনে তার জায়গায় ফিরে আসে সেই প্রথম, তারপর আবার তার জায়গায় সেই দ্বিতীয়, এরপর সেই পুরনো তৃতীয়। এ-ই পৃথিবীর নিয়ম। একদিন যা নতুন, পরদিন তা পুরনো। পুরনোর জায়গায় আরেক নতুন, তারপরে আবার পুরনো, আবার নতুন। এই চক্র পৃথিবীর শুরু থেকে। সৃষ্টির আরম্ভ থেকে। এই অর্থে পৃথিবীতে নতুন কিছু নেই। সব পুরনো। কারণ, একই পুরনো বারবার নতুন হয়ে ফিরে আসে। অথবা একই নতুন বারবার পুরনো হিসেবে পরিত্যক্ত হয়। ব্যবধান ও পার্থক্য কেবল সময়ের, রুচি-বদলের, একটাতে দীর্ঘকাল আটকে থাকার মানসিক অপারগতার। জমিদার এবং তার পুত্ররা, ওয়াঙ বা ওলান এবং তাদের সন্তানেরাÑ দুই পরিবারের জীবনই এই রকম চক্রের ভেতর ঘুরেছে। পৃথিবীর সবকিছুতে বোধ হয় এই চক্রখেলার উপস্থিতি পাওয়া যায়, কী লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে, কী পরোক্ষে-প্রত্যক্ষে! গুড আর্থ আমাদের জীবনেরই চিরায়ত কথামালা। যা একইসঙ্গে নতুনতর ও প্রাচীন। যার ভিত্তি পুরুষের প্রভুসুলভতা ও কর্তৃত্বে, নারীর সহ্য করে যাওয়া, সঁপে দেওয়া ও ভীরুতায়।

গুড আর্থ দীক্ষা দেয়-

এক. অর্থ-বিত্ত-বৈভব-জৌলুস-শৌখিনতা-নারী-পুরুষ ও নেশার প্রতি মানুষের কামনার আগুন কেবল ঊর্ধŸমুখী।

দুই. নারী-পুরুষ দুটো আলাদা সত্তা, দুটো গড়াও সম্ভবত ভিন্ন ছাঁচে ও ধাতুতে। তবুও এরা পরস্পর চিরন্তনের ও চিরায়তের এক মহিমাময় সুতোতে বাঁধা; যা ছেঁড়া যায় না কোনো দিন।

তিন. মাটির প্রতি মমতা সারাজীবনের জন্য মানুষের মানসিক পরিতৃপ্তির আশ্রয়। এই মাটিÑ হয়তো জমিও, মানুষের প্রথম ও প্রধান আশা এবং শেষ অবলম্বন।

চার. যৌনতা অর্থের লোভে পড়ার সর্বগ্রাসী মোহের মতো, তার আরও চাই, আরও বেশি বেশি চাই। বারবার নতুন আনকোরা মুঠি মুঠি।

পাঁচ. নারী কথা না বললে হয়তো কোনো দিনই তার মুক্তি নেই।

ছয়. পৃথিবীতে আসা একা, যাওয়াও। তবে অসৎ মানুষের সঙ্গে যাবে এক বুক দীর্ঘশ্বাস; পেছনের পড়ে থাকা প্রেম যৌনতা সৌন্দর্য সম্পদ মাটি ঘর ও নারীর জন্য। সৎ মানুষের হয়তো এ যন্ত্রণা নেইÑ তার আছে কেবল অভ‚তপূর্ব অত্যাশ্চর্য অসীম অবারিত আনন্দ-প্রাপ্তির অসহ্য প্রতীক্ষা।

সাত. মানুষের লাশের প্রতি তার উত্তরাধিকারী অশ্রæসজল চোখে তাকিয়ে থাকলেও তার দৃষ্টি ও মন থাকে অর্থে আর সম্পদে এবং নতুন প্রাপ্তির পরিকল্পনায় ও আশাবাদে।

শেষ কথা, গুড আর্থ নারীর দৃষ্টি দিয়ে দেখা জীবন। তাই হয়তো নারীকে এগিয়ে রাখার অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে। কিন্তু সেটি করেননি পার্ল এস বাক। তিনি জীবনকেই এঁকেছেন নিপুণ করে এবং সেটি পুরুষের ক্যানভাসে নারীর আর নারীর ক্যানভাসে পুরুষের। তাই নারীর প্রতি পুরুষের আর পুরুষের প্রতি নারীর পক্ষপাত বা বেইনসাফি থাকতে পারে, কিন্তু সেটির দায়ভার শিল্পীর নয়, পুরোটাই মানুষের জীবন, মানবিকতা ও মানসিকতার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist