মাসুমা রুমা

  ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮

গণধর্ষণ পরিবহন

গ্রামের একেবারে কোলঘেঁষে একটি ঘন জঙ্গল রয়েছে। শৈশবে খেলাচ্ছলে কতই না গিয়েছি সেখানে! কানামাছি খেলেছি, নিয়েছি চড়–ইভাতির মজা। সেই জঙ্গলে আজকাল প্রায়ই গায়েবি লাশ পাওয়া যায়। প্রতিটি লাশই নাকি নারীর নগ্ন শরীর। দেশ-গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এই আতঙ্ক মহামারির মতো নারী থেকে নারীর শরীর ও মনে সংক্রমিত হচ্ছে। মায়ের মুখে এমন অদ্ভুত অযৌক্তিক কথা শুনে কিছুটা ভড়কে গেলাম। আমার কৌতূহলী মনে কিছু প্রশ্নের উদ্ভব ঘটল। ধরলাম, জঙ্গলে গায়েবি লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিটি লাশই কেন নারীর নগ্ন শরীর? পুরুষের নগ্ন শরীর কেন নয়? তবে কি পুরুষ কখনো গায়েবি লাশ হয় না?

পেশাগত কারণে শহরে থাকি। মাঝেমধ্যেই দু-এক দিনের ছুটিতে বেড়াতে আসি গ্রামে। সারাদিনের বিরতিহীন যাত্রা শেষে খুব ক্লান্ত আমি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি, মা দরজার সামনে বসে আছে। আকাশে তখন উজ্জ্বল জোছনা। জোছনার আলো জানালা ভেদ করে আমাদের ঘরে এসেও পড়ছে। মায়ের আতঙ্কগ্রস্ত মøান দুটি চোখ, সে আলোর শরীরে বেদনার প্রলেপ দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের ছোট্ট সুখের ঘরটা তাই কুয়াশায় ভরে উঠছে। আমি মার পাশে গিয়ে বসলাম।

‘তোমার কী হয়েছে বলো তো মা?’

‘কিছু না মা। তুই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়। একদম ভয় পাবি না। আমার কোল থেকে তোকে কোনো রাক্ষসই কেড়ে নিতে পারবে না।’

‘রাক্ষস!’ এবার সত্যিই কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।

‘এই রাক্ষস নাকি একের পর এক মায়েদের বুক খালি করে চলেছে। নানান রূপ ধরে আসে রাক্ষসের দল। মারে, এই রাক্ষসের হাত থেকে কি আমার সোনার মেয়েদের নিস্তার নেই?

মা আমাকে গভীর চিন্তায় ফেলে দিল। বাকি রাতটুকু আর ঘুমাতে পারলাম না। তবু মাকে শান্ত রাখতে, রাতভর দুচোখের পাতা বন্ধ রাখতে হলো। পরের দিন থেকে মা আমাকে বাড়ির বাইরে যেতে দিল না। সারক্ষণ চোখে চোখে রাখলো। বাড়ির পরিবেশ দিন দিন অস্বাভাবিক হয়ে উঠল! আমার অস্বস্তির মাত্রা বেড়েই চলেছে। একবার ভাবলাম, জঙ্গলের দিকটায় একবার ঘুরে আসি। কিন্তু মায়ের চোখ এড়িয়ে তা সম্ভব হলো না। দিন শেষে অন্ধকার নেমে এলো। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছি। মা দ্রুত হাতের কাজ সেড়ে, আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়লো। মাকে দেখে মনে হলো, কত রাত সে ঘুমায়নি! আমাকে কাছে পেয়ে তার মস্তিষ্ক থেকে চিন্তার পাথরটা বুঝি সরে গেছে। বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিতে পারছি না। বারবার মায়ের মুখে শোনা সেই রাক্ষসটার কথা মনে পড়ছে। মুহূর্তেই আকাশের রংটা বদলে গেল। কালো চুলে ঢেকে গেল রাতের পৃথিবী। মা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পৃথিবীর এত পরিবর্তনের কোনো কিছুই সে টের পাচ্ছে না।

বাইরে প্রচ- বৃষ্টি। অথচ আমি শুনছি আমার বোন রূপার কান্না। কিন্তু কী করে তা সম্ভব? রূপা তো মৃত! কিছু মানুষ বেঁচে থেকেও মৃতের মতো জীবনযাপন করে, আবার মরে গিয়েও কেউ কেউ জীবিত হয়ে ওঠে। রূপা হয়তো তাদেরই একজন! হঠাৎ দমকা হাওয়ায় ঘরের দরজা খুলে গেল। সাদা শাড়ি পরে ঘরে ঢুকল রূপা। আমার পাশে এসে বসল সে। রূপাকে কাঁদতে নিষেধ করলাম। তবু সে কেঁদেই চলেছে। বড্ড মায়া হচ্ছে রূপার জন্য! বড্ড মায়া হচ্ছে নিজের জন্যও! আমিও তো একজন নারী! ওদিকে মা, এখনো গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন।

বৃষ্টি কমে এসেছে। সেই সঙ্গে রূপার কান্নাও। কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার সর্বাঙ্গে ভয়াবহ শূন্যতা, নখের দাগ, কালচে রক্ত, লড়াইয়ের ছাপ। আমার শরীর শিউরে উঠল। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল হঠাৎ।

‘আমি তোমাকে কিছু গল্প বলতে চাই। গল্পগুলো আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। তুমি কি শুনবে?’Ñমায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে রূপা।

‘নিশ্চয় শুনব। তুমি বলো।’Ñআমি তাকে অভয় দিলাম।

‘২০ মার্চ, ২০১৬, রাত সাড়ে ১০টা। সেনানিবাসে পড়ে আছে এক তরুণীর লাশ। মাথার হিজাব টেনেহিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে মাথার লম্বা চুল। হত্যার আগে কতটা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে মেয়েটি বলার অপেক্ষা রাখে না। অবাক করা বিষয় কি জানো? ধর্ষণ হওয়া সত্ত্বেও সে তরুণীর ময়নাতদন্তে উঠে এসেছে, তার শরীরে ধর্ষণের কোনো আলামত খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। এমন গল্প শোনার পর শ্রোতা হিসেবে আমার প্রতিক্রিয়া ঠিক কী হওয়া উচিত জানা নেই।

‘পরের গল্পটা বল।’ মাথা নিচু অবস্থায়ই রূপাকে বললাম।

‘২৮ মার্চ, ২০১৭, বনানীর চার তারকা হোটেলে চলছিল জন্মদিনের বিশাল পার্টি। দুই তরুণী এলো পার্টিতে অংশ নিতে। ফাঁদে ফেলে তাদের গণধর্ষণ করা হলো। বিশ্বাসের ঘরে চুরি যাকে বলে। শারীরিক নির্যাতনের বর্ণনা শুনলে, পুরো শরীর শিউরে উঠবে তোমার! তরুণীদ্বয় ভয়ে আতঙ্কে ঘটনার ৪০ দিনের ভেতরেও ধর্ষকের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করতে পারেনি।’

‘তবে কি আমরা হীরক রাজার দেশে পড়ে আছি?’

‘যথার্থই বলেছ। আরেকটা গল্প শুনবে?

‘রূপা, তোমার গল্প থামাও। আমি আর শুনতে পারছি না এসব। খুব ক্লান্ত লাগছে। আমার পৃথিবীটা যেন ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। এই সীমাবদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি চাই আমি।’

রূপা আমার হাত ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো। তারপর হাঁটতে শুরু করলো। আমি তাকে বাধা দিলাম না। হাঁটতে হাঁটতে পিচঢালা পথে পৌঁছে গেলাম দুজন। রূপা একবার ডানে তাকায়, একবার বাঁয়ে। গভীর রাত। পৃথিবী নির্জন। একটু পরই একটা চলন্ত বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। রূপা বাসটাকে ইশারায় থামালো। রূপার দেখাদেখি আমিও বাসে উঠলাম।

বাস চলতে শুরু করল। যাত্রী বলতে আমি আর রূপা। রূপা আর আমি ছাড়া বাসে অন্য কোনো মানুষ নেই। শুধু কয়েকটা দোপেয়ো জন্তুকে দেখতে পেলাম। মায়ের গল্পের রাক্ষসের বর্ণনার সঙ্গে যাদের অনেকটা মিল আছে। রূপা সঙ্গে থাকায় খুব একটা ভয় পেলাম না। জন্তুদের জিহ্বাগুলো কুকুরের মতো মুখের বাইরে ঝুলছিল। চোখে অশুভ কামনার আগুন। নখগুলো দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, দিনের পর দিন কত শরীর তারা খুবলে নিয়েছে, ঘাড় মটকে দিয়েছে কত কোমল স্বপ্নদের। তাদের অশুভ দৃষ্টিতে আমরা দুজন বেসামাল হয়ে পড়ছি। হঠাৎ বাস থামলো। আমরা কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে বাসের প্রবেশপথে তাকিয়ে আছি। বাসে প্রথম পা রাখলো আমার বোন তনু। জন্তুগুলো চমকে উঠল। যেন তনু তাদের পূর্বপরিচিত! এরপর একে একে পা রাখল, রূপা কিংবা তনুর মতো আমার আরো অসংখ্য বোন। সবার শরীরে সাদা শাড়ি জড়ানো। হঠাৎ লক্ষ করলাম, আমার নীল শাড়িটাও সাদা হয়ে গেছে। গাড়ি চলছে। ঠকঠক করে কাঁপছে জন্তুগুলোর পা। আমরা, বাসের সকল নারী খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। কতটা অনিরাপদ দেখাচ্ছে ওদের! রাত গভীর থেকে গভীর হয়। ওরা ভুলে যায়Ñওদের শরীরের ভেতরও শরীর আছে, অগ্নিবর্ষণকারী চোখ আছে, রক্তচোষা ঠোঁট আছে, সম্ভ্রম লেপটে দেওয়া শিরদাঁড়া আছে আর মাংস খুবলে নেওয়া শত শত ধারালো নখও আছে!

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে, জন্তুগুলো চোখ মেলে নিজেদের শরীর দেখে নেয়। তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কেননা তাদের শরীর পুরোপুরি অক্ষত আছে। আমরা আবারো হেসে উঠি উচ্চস্বরে। বাস থামে গন্তব্যের শেষ সীমারেখায়। একে একে নামতে শুরু করি আমরা সবাই। বাসের ভেতর শুধু পড়ে থাকে জন্তুগুলো। তনুসহ বাকিরা মিলিয়ে যায় সময়ের গর্ভে। আমার পাশে থাকে শুধুই বর্তমান, যাকে আমি রূপা বলে জানি। রূপা আমার হাত ধরে আবার হাঁটতে শুরু করল। জন্তুগুলো অবাক চোখে আমাদের হেঁটে যাওয়া দেখে। হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে রূপা বলে ওঠে, ‘ওহে জন্তুর দল, আমরা মানুষ। মানুষের কাছে পৃথিবীর কেউ-ই অনিরাপদ নয়।’ এই প্রথম ভুলে গেলাম নারী-পুরুষের ভেদাভেদ। আমরা হয়তো মানুষ হয়ে উঠছি!

শেষবারের মতো বাসটার দিকে আমিও একবার তাকালাম। দেখলাম, বাসের শরীরে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে ‘গণধর্ষণ পরিবহন’। তবে কি মায়ের গল্পের সেই রাক্ষস এই পরিবহনেরই ড্রাইভার?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist