মনসুর হেলাল

  ০৫ জানুয়ারি, ২০১৮

‘তিথিডোর : মুক্তিযুদ্ধের একটা উপন্যাস হতে পারতো’

স্বকালের অব্যর্থ চিত্র

জীবন কখনো কখনো গল্পের চেয়ে বিস্ময়কর, তবে গল্পকে সব সময়ই জীবনের মধ্যে বিশ্বাস্য হতে হয়। তার যেটুকু বিস্ময়কর তা মূলত বিশ্বাসের কৌশল। প্রবহমান সময়ের বস্তুগত চেহারা, কথাশিল্পে যতটা আলোকিত তত অন্য কোথাও নয়। ‘বাংলাদেশের কথাসাহিত্য : বিষয়-আশয়’ প্রসঙ্গে স্বীয় অভিজ্ঞানে এমনই অকাট্য বিশ্লেষণ আবু হেনা মোস্তফা কামালের। তার কথার অবশেষ ধরেই স্বীকার করতে হবে, ঊনিশ শতক থেকে বাংলা কথাসাহিত্য সমকালীন উদ্ভিন্নমান মধ্যবিত্তের জীবনের ভুল-ভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং নৈতিক সংকট এসবই উপজীব্য হয়েছে, বিশেষ করে উপন্যাসে তার মাত্রা ছিল কালবিশেষে সমধিক। তবে আর্থসামাজিক পালাবদল ও নানা ঘাত-প্রতিঘাতে সমাজের অবয়ব যেমন রূপান্তরিত হয়েছে, তেমনি বাংলা উপন্যাসের শরীরেও সেই রূপান্তরের ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যে উপন্যাস একটি অগ্রগণ্য শিল্পমাধ্যম হিসেবে স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল। বিশেষ করে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনায়াসে ঢুকে পড়ে এ সময়ের উপন্যাসে। রাজনৈতিক আন্দোলনের ঘটনাক্রম ও এর ধারাবাহিকতা নতুনভাবে আবির্ভূত হয়।

বস্তুত সেই ধারাবাহিকতারই অনন্য এক সৃষ্টি কথাসাহিত্যিক আহমদ বশীরের ‘তিথিডোর : মুক্তিযুদ্ধের একটা উপন্যাস হতে পারতো’। এ উপন্যাসে ওঠে এসেছে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার বিস্তৃত প্রেক্ষাপট। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের একটি মর্মস্পর্শী সত্য উন্মোচিত হয়েছে এ উপন্যাসে। বলতে গেলে, যে অব্যর্থ চেতনায় রচিত হয়েছে শওকত আলীর উপন্যাস ‘যাত্রা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জনীর গল্প’। শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও বাস্তবতা’। রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’। শাহীন আখতারের ‘তালাস’। কথাসাহিত্যিক আহমদ বশীরও সেই অনুক্রম রক্ষা করেছেন তার এই উপন্যাসে। বিশেষ করে স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশের যে স্বপ্ন নিয়ে বাঙালি যুগের পরে যুগ অকাতরে আত্মত্যাগ করেছে। বিলিয়ে দিয়েছে সর্বস্ব। তা তো কালের কালিমায় কখনো লুপ্ত হতে পারে না। বরং শত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে সেই ত্যাগে বারবার উদ্দীপ্ত হয়েছে বাঙালির মৌল চেতনা। একাত্তরে সাড়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি যে স্বাধীনতা অর্জন করে, দেশে-বিদেশে তা নিয়েও চক্রান্ত কম হয়নি। বিজয়ের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে জাতি হারায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই পটপরিবর্তনের পর মাথাচারা দিয়ে ওঠে একাত্তরের পরাজিত ঘাতক চক্র। এই নিগূঢ় বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে যে সংকট ও টানাপড়েন সৃষ্টি হয় ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরেÑএই ‘তিথিডোর : মুক্তিযুদ্ধের একটা উপন্যাস হতে পারতো’ যেন সেই দুর্নিরীক্ষ্য সময়ের একটি অসাধারণ প্রতিচিত্র।

বিশেষ করে অদৃশ্য এক সুতোর মিলনে এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো যখন পুতুল নাচের উপজীব্য, তখন শহর ঢাকার এক কোণে একজন সদ্য-তরুণ কলেজের ছাত্র দুচোখ মেলে দেখছিল ভাঙনের আশীর্বাদ... এত দিন পরে তাকে দিতে হবে করুণ স্বীকারোক্তি... বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে তখন ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওলটাবার পালা। ‘জয় বাংলা’ সেøাগানের জন্য বিস্ফোরণের শব্দ হাতে তুলে নিচ্ছে কেউ, শহর থেকে পালিয়ে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে তৈরি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা, কেউবা ঘাতক পাকিস্তানি পাপচক্রকে মেনে নিচ্ছে অন্তর্ঘাতী স্বদেশবোধ থেকে, কেউ নরঘাতক রাও ফরমান আলীর হাতে তুলে দিচ্ছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। সত্তরের নির্বাচন শেষে ঢাকা শহরের নয়াবাজারের মোড়ে পড়ে আছে আওয়ামী লীগের নৌকার বিজয় তোরণ। আর তার পাশে বংশালের হোটেল সাইনু পালোয়ানের সাইনবোর্ড, তার পাশে পুরোনো এক বাড়ি, নাম তার তিথিডোর। সেই বাড়ির মেয়েটা, ঘোড়ার গাড়িতে করে যাকে যেতে হতো কামরুন্নেসা স্কুলে, তারও তো মুক্তিযুদ্ধ আছে! আছে বুক ভরা অভিমান। কেন তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে? সেই নিরিখে ‘তিথিডোর : মুক্তিযুদ্ধের একটা উপন্যাস হতে পারতো’ বাংলা কথাসাহিত্যে এক ব্যাপক মহিমা নিয়ে হাজির হয়। বিশেষ করে নারীদের দ্রোহচেতনা ও স্বাধিকারের বিষয়টি এ উপন্যাসে প্রাধান্য পায়। এ ছাড়া ইতিহাসের নির্মম এবং নির্মোহ চাবুক কয়েকজন মানুষের জীবনকে কীভাবে ক্ষতবিক্ষত করতে পারে তারই একটি খ-চিত্র এঁকেছেন কথাসাহিত্যিক আহমদ বশীর।

এই উপন্যাসের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে অবশ্যই এ কথা স্বীকার করতে হবেÑস্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে ‘তিথিডোর : মুক্তিযুদ্ধের একটা উপন্যাস হতে পারতো’ নিঃসন্দেহে স্বকালের চিত্রকে ধারণ করেছে। স্বজাত্য বোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দিয়েছে অপ্রতিরোধ্য গতি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist