মুহ. ফজলুর রহমান

  ০৫ জানুয়ারি, ২০১৮

মনের ভেতরে দিবারাত্রির আঁধার

কবি অরণ্য রেযা। তিনি কবিতা বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘নিকষ আঁধারে একা’। সব্যসাচী থেকে প্রকাশিত। ৮৩টি কবিতার সংগ্রহ ছয় ফর্মার এই বই। কপোতাক্ষ নদ, ভৈরব নদ আর মধুমতী নদীবিধৌত প্রাচীন যশোরাদ্য দেশে কবির জন্ম। বহুদিন থেকে শিল্পী-সাহিত্যিকগণকে যশোর ভূমি কোল দিয়েছে। কবিতা ফসলের জন্য উর্বর এ জমি। ‘নিকষ আঁধারে’ কবি একা রয়েছেন তাকে সঙ্গ দিতে, তার তত্ত্ব তালাশ নিতে সাহস করে ঢুকে পড়ি ‘নিকষ আঁধারে’। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বহুল পঠিত শ্রীকান্ত উপন্যাসের কিয়দাংশ ‘আঁধারের রূপ’ স্মরণে এলো। শরৎচন্দ্রের বিবরণে ছিল রাত্রিকালে সমুদ্রবক্ষের অন্ধকার। অরণ্য রেযার বইয়ে মনে হচ্ছে নিসর্গের নয়, বরং মনের ভেতরে দিবারাত্রির আঁধার দেখেন তিনি।

যুদ্ধকালে এবং যুদ্ধের পরে মানুষের মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত মানবিক মূল্যবোধের পুনর্গঠন সময় সাধ্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিরোশিমা নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞের পরে যুদ্ধ শেষ হলে সনি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মি. সনি (সনি সান) এবং তার বন্ধুরা জীবনের অনিশ্চয়তার মস্ত আঁধারকে মোকাবিলা করতে সংগীতকে মানুষের আত্মার খাদ্য ভেবেছেন। জীবনে স্বস্তি ও স্থিরতার খোঁজে আপামর জনগণ যেন কম খরচে ভয় ও আতঙ্কের সর্বনাশী কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সে রকম ইলেকট্রনিকশিল্প গড়ে তুলতে শুরু করেন। বর্তমান বিশ্বে বহুজাতিক ‘সনি’ কোম্পানির সেই শুরু। সনি বললেন, যুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষ খাদ্য নিরাপত্তা পেলেই যুদ্ধের ভয়াবহতা ভুলে থাকতে চাইবে; সে জন্য তারা সংগীত ও বিনোদন খুঁজবে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতা জাপানের জন্য সনির ভবিষ্যদ্বাণীর ফিলহাল অনুরূপ। আমাদের দেশে আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ এবং তরুণ সমাজের নেশাজাতীয় দ্রব্যের দিকে ঝুঁকে যাওয়াকে সনি হয়তো তার মতো করেই দেখতেন। তাই ‘নিকষ আঁধার’ পেরিয়ে যেতে আমরা পেয়ে গেছি কবি অরণ্য রেযার এক গুচ্ছ স্বাদু প্রেমের কবিতা। স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, নির্বাচন, শ্রমিকের কঠিন জিন্দেগিÑএসব নিয়ে কয়েকটি কবিতা আছে এই বইয়ে। গহিন অরণ্য যেমন দিনের বেলাতেও থাকে ছায়া ছায়া অন্ধকার, তবু গাছ, লতাপাতা, খানাখন্দ চেনা যায়, এই কাব্যগ্রন্থ ‘নিকষ আঁধার’ কিছুটা হলেও তেমনি।

স্বদেশের মানুষের ওপর ব্যাপক অনাস্থা কবিকে ঘিরে ধরেছে। ১৯৬৯ সালে জন্ম নিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন স্বাধীন বাংলাদেশে। তার বোধ বুদ্ধি পরিণত হয়েছে স্বাধীনতা অর্জনের পরে। তার বেড়ে ওঠার কালে দেশ ও সমাজ অতিক্রম করেছে কঠিন সময়। সমাজে নানাবিধ অনাচার, অত্যাচার, অবিচার, শোষণ ও দুর্নীতির গ্রাস প্রত্যক্ষ করেছেন। সমাজসচেতন, কবি শ্রমিকের অবস্থানকে দরদ দিয়ে চিত্রায়ণ করেছেন।

‘ত্রাস’, ‘নির্বাসনে স্বাধীনতা’, ‘শ্রমিকের ঘাম ঝরবেই পুঁজি পাহাড় গড়বেই’ প্রভৃতি কবিতা তার হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতির প্রকাশ। নমুনা দেখা যাকÑ‘সব সময় ভয় হয়/পুলিশের বেশে/কখন কে আসে?/ভুল ভেবে ভুল কথায়/যদি যাই ফেঁসে/ভয়ে মরি ভেবে ভেবে/আরো মরি ত্রাসে’। ‘টুঁটি চেপে’ কখন কী হয়, ‘আঁধার গলিতে’ কখন হয়ে যাবেন ‘কুপোকাত’ (ত্রাস পৃষ্ঠা ৭২-৭৩) এ রকম ভয় সৃজন করে ঘন আঁধার। ‘আহা ওহো মে দিবস তোমাকেই পরিহাস/করে তারা আজো পার পাচ্ছে/তোমারই ভাঙিয়ে নাম কিনছে তারাই সুনাম’ (শ্রমিকের ঘাম ঝরবেই পুঁজি পাহাড় গড়বেই) পৃষ্ঠা ৭৯)। শিরোনামের প্রথম কবিতাটিও এই ঘরানার। আল্লাহর দান বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে যারা নষ্ট করছেন তিনি তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উচ্চারণ করেন। প্রতিশ্রুতিশীল আকর্ষক কবিতা এইটি। উপযুক্ত পরিমার্জনা করা হলে মহৎ কবিতা হবে। হতাশার অন্ধকারে তিনি একাকী বোধ করেন। সুখের বিষয় প্রাকৃতিক নিসর্গ তাকে দিয়েছে প্রেরণা। অন্ধকারকে মোকাবিলা করার কারুতা রয়েছে তার। তালগাছের মাথার ওপর দিয়ে এক টুকরো আকাশ খুঁজে নিতে পারেন; ছোট্ট জলায় যেখানে ‘ডানকানা’ মাছেরা কিলবিল করে। শহরের ফুটপাতে কুকুর, কাক, বিড়ালের সমাজ সংসার কোলাহল, হলাহলের সঙ্গে সমঝোতাও দেখেন তিনি। ফুটপাতে ফোটা ফুল, ফুলগাছের কেয়ারি, বনসাইগাছ দেখতে পান কেবল মানুষের মধ্যে দেখতে পান না মায়া, মমতা, সহমর্মিতা, একটু সহানুভূতি অর্থাৎ মানবিকতা।

মানুষের হিংস্রতা ও নানা কূশ্রিতা দেখে প্রখর রৌদ্রেও তিনি নিকষ কালো আঁধার জমাট দেখতে থাকেন। সৌভাগ্যক্রমে কবির বন্ধুরা তাকে ছেড়ে যায় না। তার প্রেম থাকে। প্রেম নিবেদনে ‘প্রত্যাখ্যাত’ হবেন জেনেও শঙ্কাহীন থাকেন; পুনর্বার জলে ভাসেন; কল্পনায় সুখের জীবন গড়েন। নিসর্গে তখন খরগোশের খুশিয়ালি জীবন বহমান; শায়েরের কবিতায়; ‘প্রেমের তুফান’।

কয়েকটি কবিতায় আমার দ্বন্দ্ব লাগে, প্রশ্নাতুর হই। এগুলো হলোÑ‘বৃত্তবন্দি’, ‘ইচ্ছেগুলো দমন করছি’, ‘সঙ্গমে সহমরণ’; ‘মেঘ তুমি বর্ষা নামাও’; ‘কেবল স্মৃতির ঘায়েই মারতে পারো’; ‘দুঃখ চারিধার’; ‘সাধ’; ‘মরতে রাজি ছোঁয়া পেলে’Ñ এগুলোর প্রতিটি রচনায় মৃত্যুর অনুষঙ্গ আছে। কখনো দুঃখ পেতে পেতে পরশ পাথর হতে চান, যেন তাকে ছুঁঁয়ে তার প্রিয়া সোয়ান হয়ে যান (গরফধং ঃড়ঁপয) এতটা না হয় সহ্য করা গেল। কিন্তু যখন পীনোন্নত পাহাড় ‘আঁকড়ে ধরি’ তিনি ‘জীবন ভ্রমর’ খুঁজতে খুঁজতে অমিয় সুধা পেয়ে যান আর সহমরণ আকাক্সক্ষা করেন তখন অস্বাভাবিক লাগে। শিরদাঁড়াহীন সবুজ স্ত্রী ঘাসফড়িং মিথুনলগ্নে প্রথমেই পুরুষ ফড়িংয়ের মস্তক খেয়ে ফেলে; মিথুন তখনো চলমান। মিথুন শেষ হতেই স্ত্রী ফড়িং পুরুষ ফড়িংয়ের বাকি দেহটা খেয়ে ফেলে। এভাবে ভবিষ্যৎ বংশধর জন্মানোর জন্য প্রয়োজনীয় আমিষ খাদ্য সংগ্রহ হয়। কী ভয়ানক। কবি কখনো বলছেন, ‘মনের সাথে মন মিশিয়ে যেমন খুশি মারো’, ‘কেন এমন করে আমায় তুমি মারো?’ এসব উচ্চারণ খুবই প্রেম বিহ্বলতার লক্ষণ। কবি নির্মলেন্দু গুণ যখন চিৎকার দ্যান ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’Ñসেটা এক রকম লাগে শুনতে। পশ্চিম গোলার্ধে অবশ্য, রতিরঙ্গে নানা রকম অস্বাভাবিক আচরণ আছে। অন্যদিকে কবি এমন বিশ্বস্ত পুরুষ যে তিনি কখনোই ছল করেন না। তবু তিনি প্রহসনের ফাঁদে পড়েন। মনে হয়, ক্রমাগত তার এই ম্যাচিওরিটি হবে যে প্রেমকলায় কিছু ছলাকলা থাকাই স্বাভাবিক এবং সুখপ্রদ বেশি হয়। উপস্থাপনাও মধুর শিল্প, এ জন্যই ‘কনে দেখা আলোয়’ সজ্জন সাধিত, মধুচন্দন চর্চিত পাত্রী দেখার ব্যবস্থা করা হয়। উপস্থাপনার ছলাকলা নিশ্চয়ই কবিতা।

কবি পাবলো শাহি ২০১৫ সালে ছোটকাগজ চিহ্নতে প্রশ্ন করেছিলেনÑ‘কবিতা কি নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও অ্যাসিডের স্মৃতি ধরে রাখে?’ (পৃষ্ঠা ৫৪, অযৌক্তিক অধিবিদ্যা) জেন্ডারবিষয়ক চিন্তাভাবনায়। আমার ধারণা, কবি অরণ্য রেযার কবিতা নারীর প্রতি সম্ভ্রম বোধ বাড়াতে ক্রিয়াশীল হবে। তার কবিতা পড়ে আশা করা যায় পুরুষদের আচরণে সংযম ও ভদ্রতা মূল্যবোধ হিসাবে জায়মান হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist