এখলাসুর রহমান

  ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭

রসরাজ

ঘরে খাবার নেই। হাওরে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে চাল কিনতে হবে। আমি মাছ ধরি, কিন্তু খেতে পারি না। নিজে খাই চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা দিয়ে। মা উপোস হয়ে বসে আছে। আমি ও মা রাতে পান্তাভাত খেয়েছিলাম কাঁচা লংকা দিয়ে। পেটটা চুঁচুঁ করছে খিদেয়। অভাবের সংসারে জন্ম বলে পড়ালেখা করতে পারিনি। নাম দস্তখতও শিখতে পারিনি। কে শেখাবে, আমার মায়েও পড়ালেখা জানে না। প্রতিবেশী সোলায়মান মেম্বারের ছেলে হাদিছ মিয়া পড়ালেখা করে। সে আমারই সমবয়সী। দেখি সারাক্ষণ মোবাইল টেপা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমি একদিন তারে জিজ্ঞেস করলাম, মোবাইলে এমন কী আছে যে, এটা নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাক। হাদিছ মিয়া বলল, ফেসবুক চালাই। ঘরে বসে দুনিয়ার সব খবর পাই। তুই মুর্খ মানুষ বুঝবি না। আমি বললাম, ফেসবুক জিনিসটা কী? হাদিছ মিয়া বলল, ফেসবুকে সব ধরনের মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়। প্রেম-পীরিতিও করা যায়। আমি অবাক হয়ে বললাম, এটা কী জিনিস আমারে একটু দেখাও না ভাই! হাদিছ মিয়া মুচকি হেসে বলল, এখন মাছ ধরতে যাচ্ছিস যা। অবসরে আসিস দেখামু নে। আমি জাল নিয়ে হাওরের দিকে রওনা দিই। হাদিছ মিয়া বলল, এই রসরাজ সন্ধ্যার পরে আসিস। তোরে ফেসবুক দেখামু। আমি ফেসবুক দেখমু। কী জিনিস এটা!

হাওরে মাছ ধরায় মন বসছে না। ঘোলা পানি ও কাদায় সারা শরীর লেপ্টে গেছে। আমাকে কেউ দূর থেকে হঠাৎ দেখলে জলজ ভূত ভাববে। জাল ঠেলছি আনমনাভাবে তাই মাছও বেশি পড়ছে না। কিন্তু মাছ না পেলে খামু কী। আমি উপোস থাকব আর আমার মা উপোস থাকবে। আমার অসহায় মায়ের অনাহারী মুখটা আমি সইতে পারি না। আমার মা অপেক্ষায় আছে আমি চাল কিনে ঘরে ফিরব। তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে সড়কের ধার হতে চটবন কুড়োচ্ছেন। তেল কিনে নিতে না পারলে বিনা তেলেই শাক রান্না করবেন মা। সন্ধ্যার আগে আগেই জাল নিয়ে ডাঙায় উঠলাম। কাদা পানিতেই শরীরের কিছু কাদা পরিষ্কার করে নিলাম। পাশের একটি ডোবামতো জায়গায় জল পরিষ্কার ছিল। এখানে কচুরিপানার শুকনো ছোলা দিয়ে শরীর ঘষে পরিষ্কার করে নিলাম। গোসল সেরে ভেজা গামছা পরে লুঙ্গিটা রোদে শুকোতে দিয়ে বসে থাকলাম। আমার একটাই লুঙ্গি। এটা শুকোলে তা পরেই বাজারে যেতে হবে। বাড়িতে গোসল করে অনেক সময় মায়ের ছেঁড়া শাড়ি পরি। এজন্য যারা শাড়ি পরা অবস্থায় আমাকে দেখে তারা আমায় নিয়ে হাসাহাসি করে। তাদের হাসিকে আমি কোনো গুরুত্ব দিই না। কারণ, আমি বুঝি আমার জীবন আর আমাকে নিয়ে যারা হাসছে তাদের জীবন এক নয়। আমি রসরাজ। আমার বাপ-দাদা-চৌদ্দ গোষ্ঠী ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের অচ্ছুত জেলে। আমরা কেউ কোনো বিদ্যালয়ে যাইনি। নাম দস্তখতও জানি না কেউ। তবে স্কুলের ধারে যদি কেউ গিয়ে থাকি, তাহলে গিয়েছি মাছ ধরতে। স্কুলের লোকেরা অনেকবার আমাকে দিয়েও তাদের পুকুরে মাছ ধরিয়েছে। তখন দেখেছি স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের চঞ্চলতা। দেখেছি তাদের বগলে চাপা বই। আহা নতুন বইয়ের গন্ধ কী মধুর! আমি শুঁকতাম আর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতাম নতুন বইঅলা চঞ্চল ছাত্রছাত্রীদের দিকে। ভগবান আমাকে তাদের মতো বই বগলে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার ভাগ্য দেয়নি। মা সরস্বতী ও মা লক্ষ্মী কেউই আমার ও আমার পূর্ব পুরুষদের দিকে তাকায়নি। তাকায়নি পূর্ব নারীদের দিকে। অথচ আমার মাকে জ্ঞান হওয়া অবধি সময় হতেই দেখে আসছি সরস্বতী পূজায় চাল দিতে ও ঘরে নিয়মিত লক্ষ্মী পূজা করতে। হাওর পারে লুঙ্গি শুকোতে দিয়ে এসব ভাবছিলাম। আরো ভাবছিলাম হাদিছ মিয়ার কাছে ফেসবুক দেখতে যাওয়ার কথা। লুঙ্গিটা পুরো শুকানোর আগেই তা পরে নিই। আধাভেজা লুঙ্গি পরে রওনা দিই নাসিরনগর হাটের দিকে। মাছ মহলে ঢুকতে যেতেই হাদিছ মিয়ার বাবা সোলেমান মেম্বার আমাকে ডাক দিল, কী রে রসা! কী মাছ আনছোস দেহি। আমি বললাম, মেম্বার সাব আমার নাম রসা না রসরাজ। সোলেমান মেম্বার তাচ্ছিল্য করে বলল, আরে রাখ তোর রসরাজ। তুই রসা। দে মাছগুলো দে!

নাসিরনগরে সোলেমান মেম্বারের প্রতিদ্বন্দ্বী সুবল কর। এলাকায় সৎ ও ভদ্রলোক হিসেবে রয়েছে তার বিপুল জনমত। তিনি আগামী নির্বাচনে মেম্বার পদে দাঁড়াবেন। হিন্দু ভোটগুলো থোকভাবে পেলে আর সিকি ভাগ মুসলিম ভোট টানতে পারলেই সুবল করের জয় নিশ্চিত। ভালো মানুষ হিসেবে মুসলমানদের মাঝেও তার একটি ইমেজ রয়েছে। গত নির্বাচনে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগিয়ে সোলেমান মেম্বার জিতে যায়।

সোলেমান মেম্বারের কাছে মাছগুলো বিক্রি করে দেড় কেজি চাল, অল্প চ্যাপা শুঁটকি ও অল্প অল্প করে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ-রসুন নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করলাম। মাকে বললাম, রান্নাটা একটু তাড়াতাড়ি করো মা। আমি একটু সোলেমান মেম্বারের ছেলে হাদিছ মিয়ার কাছে যাব।

মা বলল, এরা তো মানুষ ভালা না বাবা। হের লগে কী দরকার তোমার?

আমি বললাম, হাদিছ মিয়া আমারে ফেসবুক দেখাইব মা। আমি ফেসবুক দেখবাম।

মা বলল, ফেসবুক কিতা বাপ! এইডা দিয়ে কিতা করে?

আমি বললাম, আমি আগে দেখে আসি মা পরে কইয়াম নে।

আমার কথায় মা নীরব রইল। বলল, আচ্ছা যাও। তাড়াতাড়ি আইয়ো।

আমি তড়িঘড়ি করে সোলেমান মেম্বারের বাড়িতে গেলাম। মেম্বার আমারে দেখেই বলল, কী রসা আইচো, যাও হাদিছ মিয়া তোমার জন্য বসে আছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, হাদিছ মিয়া আমারে ফেসবুক দেখাবে তা তার বাবাকে বলতে গেল কেন?

হাদিছ মিয়া আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, আইচো রসরাজ। আইয়ো। ঘরের ভেতরে আইয়ো। আমি হাদিছ মিয়ার পাশে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। সে তার টাচ মোবাইলটা নিয়ে বসল। আমাকে বলল, এখানে টিপ দাও। আমি ভয়ে ধরলাম না। টাচ মোবাইলের কথা শুনেছি ও দূর হতে দেখেছি, কিন্তু কখনো ছুঁঁয়ে দেখিনি। ছুঁঁলে কী হতে যেয়ে কী হয়ে যায়? হাদিছ মিয়া ফেসবুকে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি দেখালো। বলল, তোমাকেও একটা ফেসবুক আইডি খুলে দিচ্ছি। দাঁড়াও তোমার একটা ছবি উঠাই। হাদিছ মিয়া তার মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে আমার একটি ছবি উঠাল। বলল, তোমার বাবার নাম, পরিচিতি ও ঠিকানা দিয়ে তোমার নামে একটা আইডি খুলে দিলাম। তোমার প্রোফাইলে কিছু সুন্দর সুন্দর ছবিও পোস্ট করে দিবনে। কি বল দেব?

আমি বললাম, আচ্ছা দিয়ো। কিন্তু আমি যে এসব চিনি না। তাছাড়া আমার যেকোন মোবাইলও নেই?

হাদিছ মিয়া বলল, কাল আবার এসো। আমার মোবাইল দিয়ে তোমারে তোমার ফেসবুকটা দেখিয়ে দেব ও তা কিভাবে চালাতে হয় তাও চিনিয়ে দেব। এখন সারা দুনিয়ার মানুষ রসরাজকে দেখবে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, এই রসরাজ জেলেকে কী দেখবে মানুষ?

হাদিছ মিয়া বলল, তোমার ছবি আপলোড দিলাম।

আমি বললাম, আপলোড মানে?

হাদিছ মিয়া বলল, আরে বোকা আপলোড মানে তোর ছবি ফেসবুকে পাঠালাম। প্রোফাইলে শুধু একটি ছবি থাকলে হয় না তাই আরো কিছু ছবি দিলাম।

আমি বললাম, আইচ্ছা ঠিক আছে।

হাদিছ মিয়া বলল, তোমার প্রোফাইলটা গুছিয়ে রাখব। আগামীকাল ভালো করে দেখাব নে। সন্ধ্যার পরে এসো।

আমি বললাম, প্রোফাইল মানে কী?

হাদিছ মিয়া বলল, তোর পরিচিতি। কাল এলে পুরোটা বুঝিয়ে দেব।

পরদিন আমি মাছ ধরে ও নাসিরনগর হাটে বিক্রি করে অন্যদিনের তুলনায় আগে আগে বাড়ি ফিরছিলাম। নাসিরনগরে শত মানুষের মিছিল যাচ্ছে। তারা স্লেøাগান দিচ্ছে কাবাঘরের অসম্মানকারীর ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই। নাস্তিকটার দুই গালে জুতা মারো তালে তালে। নাস্তিক রসরাজের ফাঁসি চাই দিতে হবে।

আমি চমকে ওঠি। আমার নামে নাম কে সেই রসরাজ? মুসলমানরা সব একজোট হয়ে ততক্ষণে রাস্তায় নেমে এসেছে। হিন্দুপাড়ায় হামলা চালাল। নাসিরনগরের পুলিশ প্রশাসন কাবাঘর অবমাননার বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের প্রতি সংহতি জানাল। মিছিলে হাদিছ মিয়ার বাবা সোলেমান মেম্বারকেও দেখলাম। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ঘটনা ভাই। কোন রসরাজ। রসরাজটা কে?

লোকটি বলল, রসরাজ নামের এক হিন্দু যুবক কাবাঘরে শিবের ছবি লাগিয়ে আপলোড করেছে। ফেসবুক হতে রসরাজের ছবি বের করে পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। মিছিলের কয়েকজন রসরাজকে গভীরভাবে দেখছে। একজনকে কী জানি ইশারা করল ওমনি সে একটা ছবি বের করল। ছবিটা দেখেই লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, আরে এইতো রসরাজ। ধর মালাউনের বাচ্চারে ধর!

আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই আমাকে মারধর করতে লাগল। মেরে রক্তাক্ত করে পরে আমায় পুলিশের হাতে তুলে দিল।

আমি আহত ও রক্তাক্ত হয়ে জেলে গেলাম। ফেসবুক দেখার খেসারত আমাকে ও গোটা সম্প্রদায়কে এভাবে দিতে হবে ভাবিনি। আমি যতই বলি, আমি পড়ালেহা জানি না। মুর্খ মানুষ আমি, ফেসবুক চালাতে জানি না। ফেসবুক চালাব কী দিয়ে আমার কোনো মোবাইলই নেই। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না! আমাকে তারা জেলে দিল। এদিকে সোলেমান মেম্বার এটাকে ইস্যু করে মুসলিম ভোটারদের কাছাকাছি চলে গেল। সুবল কর নির্বাচনে দাঁড়ালে আর মুসলমানদের ভোট পাবে না। খালি হিন্দু ভোটে যে সে আর জিততে পারবে না সেটা নিশ্চিত হয়ে গেল। সুতরাং সোলেমান মেম্বারের বিজয় আর কে ঠেকায়? আমি রসরাজ অপরাধ না করেও হয়ে গেলাম জেলখাটা অপরাধী!

একজন জেল পুলিশ বলল, জেলে থাকলে বেঁচে থাকবি বেটা। বাইরে গেলে মারা পড়বি। জেল হতে ছাড়া পেলে দূরে কোথাও পালিয়ে যাস। বাড়িতে গেলে তোর জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না। আমি জেল হতে বেরিয়ে দেখি আমার মা জেল গেটে দাঁড়িয়ে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি দূরে কোথাও পালিয়ে যাও বাজান। ওরা তোমারে মাইরা ফেলবে! হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল আমার অসহায় অসুস্থ মা। আমি মাকে সান্ত¦না দিয়ে বললাম, আমি তোমারে ছাইড়া কোথাও যাবো না মা। আমি কোনো দোষ করি নাই। আমি লেখাপড়া জানি না মাছ মাইরা খাই। মাছ মারতে গেছিলাম, বাড়িতে যাওনের সময় কিছু লোক আমারে মাইর ধোর করছে। পরে পুলিশে দিচে। ফেসবুক কিতা আমি জানি না। আমি লেখাপড়াই জানি না আমি না কি কী লিখছি! হেরার ডরে আমি দেশ ছাইড়া যাইতাম না। অহন আমি বাড়িত যাইয়াম। সোলায়মান মেম্বারের পোলারে জিগাইবাম আমারে ফেসবুক দেখানোর কথা কইয়া কী করছ তুমি!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist