রেজওয়ান শরিফ, টাঙ্গাইল

  ১৮ জুন, ২০২০

মৃত্যুর পর জানা গেল তারা করোনায় আক্রান্ত ছিলেন

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার পোস্টকামুরী এলাকার বাসিন্দা শামছুল আলম (৫৬) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে মৃত্যুবরণ করেন। গতকাল বুধবার সকালে তার লাশ দাফনের পর পরিবার জানতে পারে তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। একই উপজেলার বহুরিয়া ইউনিয়নের চান্দুলিয়া গ্রামের কৃষক শমসের (৬৫) করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত সোমবার মৃত্যুবরণ করেন। তার পরিবারও গত সকালে জানতে পারেন শমসের করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। তাদের দুজনের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয় গত ৯ জুন। নমুনা সংগ্রহের আট দিন পর পরিবার এই দুজনের করোনা সংক্রমিত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়। আক্রান্ত হওয়ার পর এক সপ্তাহ অতিক্রমকালে তারা দুজন পরিবার, স্বজন ও এলাকার আরো কাউকে সংক্রমিত করেছেন কিনা এই প্রশ্ন এখন সবার? নমুনা পরীক্ষার ফল এত দেরিতে আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আতঙ্কিত পরিবারসহ এলাকাবাসী। শুধু শামছুল আলম কিংবা শমসেরের পরিবার নয়, করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার বিষয়টি এখন টাঙ্গাইলের জনমানুষের মধ্যে এক আতঙ্ক ও আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ নমুনা পরীক্ষার ল্যাবের দাবি করেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

টাঙ্গাইল পৌরসভার মশিউল ইসলাম খান। তার শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা দিলে তিনিও গত ৯ জুন নমুনা প্রদান করেন। তার শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতির পজিটিভ রিপোর্ট আসে বুধবার সকালে। পারিবারিকভাবে সচেতন থাকায় শরীরে উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর থেকেই তিনি নিজ গৃহে আইসোলেশনে থেকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে থাকেন। তার শরীরে আগে থেকেই বহুমুত্র, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের উপস্থিতি থাকায় গত তিন দিন আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে আইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে দুবার তার করোনাভাইরাসের টেস্ট করা হলে দুবারই নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। এখন তার পরিবারের প্রশ্ন তিনি কী আসলেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন?

নমুনা সংগ্রহে ধীরগতি এবং পরীক্ষার রিপোর্ট দেরিতে আসায় দিনদিন টাঙ্গাইলে ভাইরাসটি মহামারিতে রূপ নিচ্ছে। মানুষের মধ্যে নানা কুসংস্কারের কারণে অনেকেই আক্রান্ত হয়েও প্রকাশ করছে না। আবার আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেলে তার পরিবারের লোকজন সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে কিংবা লাশ দাফন বা সৎকারে বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় লাশ গ্রহণ করছেন না। গত ১৪ জুন ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দেলদুয়ার উপজেলার পাকুল্লা এলাকায় রাস্তার পাশে থেকে পুলিশ অজ্ঞাত একটি লাশ উদ্ধার করে টাঙ্গাইল শ্মশানে দাহ্ করে প্রশাসন। গোয়েন্দা পুলিশ তার নাম ঠিকানা উদ্ধার করে জানতে পারেন মৃত ব্যক্তির নাম চেতন চন্দ্র দাস (৩০)। সে কালিহাতী উপজেলার আমজানী গ্রামের নকুল চন্দ্র দাসের ছেলে। ঢাকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তার বাবা ও বড় ভাই অতুল চন্দ্র দাস সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে এবং লাশ দাহ্ করতে দেওয়া হবে কিনা এই আশঙ্কায় রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। কয়েক দিন আগে একই রকম ঘটনা ঘটে ভূঞাপুরে। সেখানেও লাশ দাফনে বাধা দিলে পুলিশি পাহাড়ায় প্রশাসন প্রটোকল অনুযায়ী লাশ দাফন সম্পন্ন করে।

টাঙ্গাইল সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রেরিত তথ্যানুযায়ী বুধবার পর্যন্ত টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলায় মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৫৯ জন।

এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫৯ জন, কালিহাতীতে ৩২, ঘাটাইলে ২১, মধুপুরে ২৮, ধনবাড়ীতে ২০, গোপালপুরে ১৭, ভূঞাপুরে ১৩, দেলদুয়ারে ২৬, নাগরপুরে ৩০, বাসাইলে ৮, সখীপুরে ১৩ এবং মির্জাপুরে ৮৯ জন রয়েছে। এর মধ্যে মির্জাপুর পৌর শহরের ৩নং ওয়ার্ডটি ১০ দিনের জন্য লকডাউন করা হয়েছে। টাঙ্গাইল থেকে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৯০১ জনের নমুনা পাঠানো হয়। এর মধ্যে নেগেটিভ রিপোর্ট আসে ৫ হাজার ৯২৭ জনের। রিপোর্ট পেন্ডিং রয়েছে ৬৩২টি।

এদিকে টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় ৪০ লাখের উপরে জনসংখ্যা রয়েছে। এখানে যে পরিমাণে নমুনা পরীক্ষা হওয়ার কথা সেটা হচ্ছে না। সীমিত পরিসরে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও তার ফল আসতে সময় লাগছে এক সপ্তাহ। ফলে এরই মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি পরিবারসহ অন্যদের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এরই মধ্যে ৩৫৯ জন আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ১২৭ জন সুস্থ হয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন আটজন। সম্প্রতি এক ভিডিও কনফারেন্সে টাঙ্গাইলবাসীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য একটি আরটিপিসিআর মেশিন চাওয়া হয়। সেটি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ল্যাব স্থাপনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মাসুদার রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিংয়ের পরেই আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবটি প্রস্তুত করে রাখি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি অনুমতি এবং রিয়াল টাইম পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (আরটিপিসিআর) মেশিন না আসায় পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।

টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, টাঙ্গাইলের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য ল্যাবের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মেশিন আসলেই পরীক্ষা শুরু হবে। তখন হয়তো আমরা প্রতিদিনই সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষার ফল ওইদিনই দেওয়া সম্ভব হবে। তবে তিনি পরীক্ষার ফল দেরিতে আসায় সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, নমুনা সংগ্রহ করার সময় তাদের বলা হয় কোয়ারেন্টাইনের থাকতে। তারা সচেতন না হয়ে বাড়ি থেকে বের হলে আমাদের কিছু করার নেই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close