নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২২ মে, ২০২০

আইলার ক্ষত তাজা করে দিল আম্পান

প্রবল শক্তি নিয়ে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় আম্পান অবশেষে শক্তি হারিয়ে চলে গেল। ডানা ঝাপটা দিয়ে গেল পশ্চিম উপকূলে। ঘূর্ণিঝড়টির মূল কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের দিঘা এবং কলকাতায় প্রচণ্ড ধাক্কা দিলেও এর প্রভাবে বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলীয় জেলাগুলো ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। আম্পান যখন এই ধাক্কা দিল, এর মাত্র তিনদিন পরেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার ১১ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। ২০০৯ সালের ২৫ মে এই ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায়। সেই ক্ষতই যেন তাজা করে দিয়ে গেল ঘূর্ণিঝড় আম্পান।

এ পর্যন্ত পাওয়া খবরের সূত্রগুলো বলছে, আম্পানের ঝাপটায় এবারও সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা। বেশ কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ধ্বসে পানি ঢুকেছে লোকালয়ে। প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ঘূর্ণিঝড়ের মূল কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গে আঘাত করলেও প্রবল বাতাসের তোড় পশ্চিমাঞ্চলসহ গোটা উপকূলকেই নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুরের বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ধসে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কমবেশি সমগ্র উপকূলেই আম্পানের প্রভাব লাগলেও এবারের ঝড় পশ্চিম উপকূলের মানুষদের আইলার ক্ষতই উসকে দিল। দীর্ঘ সময় নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো মানুষগুলো আবার পড়ল বিপাকে। বাগেরহাটের শরণখোলার গাবতলা। যেখানে ২০০৭ সালে আঘাত করেছিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর, সেখানে নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধ ধসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কয়রার উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী, সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ধসে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও স্থানীয় জনসাধারণ বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করা করেছে। পশ্চিম উপকূলের বাঁধগুলো এতটাই নড়বড়ে; এ বাঁধ ধসে যেতে আম্পানের মতো প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের প্রয়োজন হয়না। স্বাভাবিক জোয়ারেও ভেঙে যায় বাঁধ। ফলে বর্ষাকাল এলেই নাজুক বেড়িবাঁধের আশপাশের মানুষ আতঙ্কে থাকেন। এবারের বর্ষার শুরুতে খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার আশাশুনিতে বেশ কয়েকবার বাঁধ ভাঙার খবর পাওয়া গেছে। আম্পানের সতর্কতায় ওইসব এলাকার মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। ঘূর্ণিঝড় আম্পান এ এলাকায় ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়ে গেলÑ বলছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম। তিনি জানান, ওই ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ নাজুক হয়ে গিয়েছিল আইলার প্রলয়ে। সে সময় গোটা ইউনিয়ন ডুবে গিয়েছিল লবণ পানিতে। কৃষি জমি পরিণত হয়েছিল বিরাণ ভূমিতে। মানুষের আশ্রয় হয়েছিল বেড়িবাঁধে। আইলার পর এলাকায় তীব্রভাবে দেখা দেয় সুপেয় পানির অভাব। বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। বহু পরিবার পথে বসে যায়। এলাকার মানুষ সেই সংকট আজও সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় চাষাবাদ শুরু হয়েছিল; ১০ বছরে গাবুরার বিরাণ ভূমিতে কোথাও মাথা তুলেছিল সবুজ। এরই মধ্যে এই ধাক্কা আবার সমস্যা বাড়িয়ে তুলল।

বহু চেষ্টায় নড়বড়ে বাঁধগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল। তিনি বলেন, ২০০৯ সালের আইলার ১১ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। আজ এই দুর্যোগের দিনে সেই দিনটির কথাই মনে পড়ছে। আইলা যে ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে, তা এতদিনেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। বরং আইলায় প্রবল পানির চাপে বাঁধের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আজও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। বরং বাঁধগুলো দিনে দিনে নাজুক হয়ে পড়ছে। আম্পানের ধাক্কায় আরো নড়বড়ে হবে বাঁধ। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলের দুর্যোগে আবার বিপদ ডেকে আনবে।

খুলনা বিভাগীয় সদর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে কয়রা উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এ বাঁধগুলো বিভিন্ন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি করেছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা। দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের জোড়শিং গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, আইলায় এই এলাকার কৃষির বৈচিত্র্যই বদলে দিয়ে গেছে। একসময় এই এলাকায় মানুষ ধান কাটতে আসত বিভিন্ন এলাকা থেকে। এখন এই এলাকার মানুষজন ধান কাটতে যায় বিভিন্ন এলাকায়। যে জমিতে ধানের আবাদ হতো; সেখানে এখন চিংড়ি চাষ হচ্ছে। বহু মানুষ বেকার হয়ে গেছে। কেননা, ধান আবাদে লোকজন বেশি প্রয়োজন হলেও চিংড়ির ঘেরে শ্রমিক লাগে কম।

সাইফুল ইসলাম বলেন, আইলা যে ক্ষতি আমাদের করে দিয়ে গেছে। তা পুষিয়ে নেওয়া কঠিন। তবুও অনেক চেষ্টা করে জীবনকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে মানুষ। কিন্তু আম্পানে তো আবার ক্ষতি করে দিয়ে গেল। গত বছর ফণি-বুলবুলেও তো অনেক ক্ষতি করেছে। ক্ষতি হলেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। এরই সূত্র ধরে কামরুল ইসলাম সরদার বলছিলেন, ভাঙনে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধের ক্ষতি হলেও তা ঠিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয় না। আমাদের ঝুঁকি তো দিনে দিনে বাড়ছেই। এভাবেই বেঁচে আছি, কী করব।

ঘূর্ণিঝড় আইলা খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের একটি গ্রামকে ঝুলন্ত গ্রামের পরিণত করেছিল। গ্রামটির নাম কালাবগি। শিবসা নদীর তীরে সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামের মানুষ আইলায় সব হারিয়েছে। এবার আম্পানও নাড়িয়ে দিয়েছে ওই গ্রাম। গ্রামের বাসিন্দা মনিরুজ্জামান বলছিলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সিগনাল পেয়ে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিল। মালামাল সুরক্ষায় কিছু মানুষ ঘরে ছিল। ঘূর্ণিঝড় আম্পান গ্রামের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। বেশকিছু ঘরবাড়ি ভেঙেছে। ঘরের চালা উড়ে গেছে। ফলে ঘর গোছাতে তাদের আবার হিমশিম খেতে হবে। ঝুলন্ত গ্রামের বাসিন্দা বলছিলেন, আইলায় তো আমাগো সব শ্যাষ করে দিছে। এভাবে বার বার দুর্যোগ এলে আমরা কীভাবে বাঁচি?

বিগত কয়েক দশকে চিংড়ি চাষের অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে পশ্চিম উপকূলীয় জেলাগুলো। যখন আম্পান আঘাত করল, তখন এই অঞ্চলে চিংড়ির ভরা মৌসুম। খামার থেকে বড় সাইজের চিংড়ি তুলছিলেন চাষিরা।

অনেক স্থানের চিংড়ির ঘেরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পাইকগাছার সোলাদানার চিংড়ি চাষি সোহরাব হোসেন বলেন, এখন ঘের থেকে চিংড়ি ধরার মৌসুম। কিছু বাজারে গেছে। আরো অনেক চিংড়ি রয়ে গেছে ঘেরে। আম্পানের প্রভাবে পানির চাপে ঘেরের বাঁধ ধসে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছি। কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে পশ্চিম উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় চিংড়ি চাষিরা চরম বিপাকে পড়বেন। অনেককেই লোকসান গুনতে হবে। করোনাভাইরাসের কারণে এ অঞ্চলের চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষিরা দুই মাস ধরে এমনিতেই সংকটে রয়েছে। এরপর ওপর আম্পানের এই ধাক্কায় তাদের নতুন সংকটের মধ্যে ফেলবে। এছাড়াও প্রভাব পড়বে জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close