আদালত প্রতিবেদক

  ২৫ এপ্রিল, ২০১৯

যুদ্ধাপরাধ

নেত্রকোনার আঞ্জু-ছোরাপের ফাঁসি

একাত্তরে নেত্রকোনার আটপাড়ায় হত্যা, গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার দায়ে দুই আসামির ফাঁসির রায় এসেছে যুদ্ধাপরাধ আদালতে। গতকাল বুধবার বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। দুই আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা সোহরাব আলী ওরফে ছোরাপ রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আরেক আসামি হেদায়েত উল্লাহ ওরফে আঞ্জু বিএসসি পলাতক রয়েছেন।

একাত্তরে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং আটপাড়ার মধুয়াখালী, মোবারকপুর ও সুখারী গ্রাম এবং মদন থানার মদন গ্রামে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান বলে উঠে এসেছে এ মামলার বিচারে। ২১৮ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত বলেছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ছয়টি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি অভিযোগে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে। বাকি তিন অভিযোগের প্রত্যেকটিতে তাদের ১০ বছর করে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে আঞ্জুর ভাই এনায়েত উল্লাহ ওরফে মঞ্জুকেও আসামি করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা গেলে তার নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়। পরে ওই বছরই কারাগারে থাকা ছোরাপ ও পলাতক আঞ্জুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। বিচার কাজ শেষে আদালত বুধবার তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সাজার রায় দেন। এই রায়ের একমাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন আসামিরা। তবে সে সুযোগ নিতে হলে পলাতক হেদায়েত উল্লাহ ওরফে আঞ্জুকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিশ্বের মানুষ এখন গণহত্যার বিরুদ্ধে সক্রিয় ও সচেতন। ট্রাইব্যুনাল আগেও উচ্চারণ করেছেন, এবারও উচ্চারণ করলেন- গণহত্যা আর না। অন্যদিকে আসমিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আবদুস শকুর খান সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।

আর পলাতক যিনি আছেন তিনি যদি আদালত, রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তাহলে আশা করি, দুজনেই খালাস পাবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৩৭টি মামলার ৯৫ আসামির মধ্যে ছয়জন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ৮৭ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৬০ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।

মামলার বৃত্তান্ত : প্রসিকিউশনের তদন্ত দল এ মামলার অনুসন্ধান শুরু করে ২০১৫ সালের ৫ মে। আঞ্জু, মঞ্জু ও ছোরাপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অভিযোগের বিষয়ে ৪০ জনের জবানবন্দি শোনেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তিন জনেরই গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার আটপাড়া থানার কুলশ্রীতে। একাত্তরে তারা ওই এলাকাতেই থাকতেন। পরে আঞ্জু রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার হেতেম খাঁ মেথরপাড়ায় থাকতে শুরু করেন। আর ছোরাপ বসবাস করতেন নেত্রোকোনার মদন থানার জাহাঙ্গীরপুরে। ছোরাপকে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাকে ট্রাইব্যুনালের এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। আর এনায়েত উল্লাহ ওরফে মঞ্জুকে গ্রেফতার করা হয় ওই বছরের ৩০ মার্চ। তার ভাই আঞ্জুকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। প্রায় দেড় বছর তদন্তের পর ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ওই তিনজনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। মামলার বিচার শুরুর আগেই ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান এনায়েত উল্লাহ ওরফে মঞ্জু।

এরপর ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামি হেদায়েতুল্লাহ আঞ্জু ও ছোরাপ আলীর বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৩ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল গত ৭ মার্চ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।

৬ যুদ্ধাপরাধ : অভিযোগ ১ : একাত্তরের ২৯ মে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার মধুয়াখালী গ্রামে ২০-৩০টি ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং গণহত্যার সমতুল্য অপরাধ। এ অভিযোগে দুই আসামির ১০ বছরের সাজার রায় হয়েছে।

অভিযোগ ২ : একাত্তরের ২৩ অগাস্ট নেত্রকোনার আটপাড়া থানার মোবারকপুর গ্রামের শহীদ মালেক তালুকদার ও কালা চান মুন্সীকে অপহরণ, হত্যা এবং লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ। এ অভিযোগে আসামি আঞ্জুর ফাঁসির রায় হয়েছে। অভিযোগ ৩ : একাত্তরের ৩০ আগস্ট নেত্রকোনার মদন থানার মদন গ্রামের শহীদ হেলিম তালুকদারকে অপহরণ ও হত্যা এবং লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ। এ অভিযোগে দুই আসামির ফাঁসির রায় হয়েছে।

অভিযোগ ৪ : একাত্তরের ৩ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনার আটপাড়া থানার সুখারী গ্রামের দীনেশ চন্দ্র, শৈলেশ চন্দ্র, প্রফুল্ল বালা, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, দুর্গা শংকর ভট্টাচার্র্য, পলু দে, তারেশ চন্দ্র সরকারকে অপহরণ, হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ এবং বেশকিছু হিন্দু পরিবারকে দেশত্যাগে বাধ্য করা। এ অভিযোগে দুই আসামির ফাঁসির রায় হয়েছে।

অভিযোগ ৫ : একাত্তরের ২ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনার মদন থানার মাঝপাড়া গ্রামের হামিদ হোসেনকে অপরাহরণ, নির্যাতন। এ অভিযোগে দুই আসামির ১০ বছরের সাজার রায় হয়েছে।

অভিযোগ ৬ : একাত্তরের ৬ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনার মদন থানার মদন গ্রামের ১৫০ থেকে ২০০টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা। এ অভিযোগে দুই আসামির ১০ বছরের সাজার রায় হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close