রাকিবুল রাকিব, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ)

  ২৪ মার্চ, ২০১৯

কোনো প্রতিবন্ধকতাই ঠেকাতে পারেনি সালমার জ্ঞানার্জনের স্পৃহা

মেয়েটির বয়স ১৬ থেকে ১৭। তিনি একজন বাকপ্রতিবন্ধী। নিজের মনের অনুভূতি মুখের ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না তিনি। কথা বুঝানোর চেষ্টা করেন ইশারা-ইঙ্গিতে। কখনো আবার লিখে। তবে বিশেষ গুণ হলো, তিনি অনেক বিষয় খুব সহজেই আয়ত্ত করতে পারেন। অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করে, প্রতিবন্ধীদের বিশেষ স্কুলে না পড়েও তিনি ২০১৮ সালে দাখিল (এসএসসি সমমান) পাশ করেছেন। বর্তমানে উপজেলার ইসলামাবাদ সিনিয়র মাদ্রাসা আলিম শ্রেণিতে প্রথম বর্ষে অধ্যয়ন করছেন। কোনো প্রতিবন্ধকতাই ঠেকাতে পারেনি সালমার জ্ঞান অর্জনের অদম্য স্পৃহা। এই মেধাবী ছাত্রী গৌরীপুর উপজেলার লামাপাড়া গ্রামের মেয়ে সালমা আক্তার।

সালমা আক্তারের বাড়ি উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের লামাপাড়া গ্রামে। বাবা মৃত আবুল কাশেম, মা মমিনা খাতুন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সালাম সবার ছোট। তিনি ২০১২ সালে লামাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী, ২০১৫ সালে লামাপাড়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসা থেকে জেডিসি ও ২০১৮ সালে একই মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেন।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে বসে সালমা আক্তারের সঙ্গে ইশারা-ইঙ্গিত ও খাতায় লিখে কথা বিনিময় হয় প্রতিদিনের সংবাদের এ প্রতিনিধির। তবে কিছু ক্ষেত্রে কথা ও প্রশ্নের ধরন বুঝতে সমস্যা হওয়ায় উত্তর দিতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন সালমা। এ সময় তাকে সহযোগিতা করেন মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ এমদাদুল হক ও তার সহপাঠী শুকতারা।

প্রথমেই পারিবারিক অবস্থা ও পড়াশোনা সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন খাতায় লিখে দেওয়া হয় সালমার কাছে। ঝটপট লিখিত উত্তরÑ ‘আমি অভাবের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। ভাবতে পারিনি এত দূর লেখাপড়া করতে পারব। তবুও একটা স্বপ্ন ছিল আমার। স্বপ্নটা হলো নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার। ভাইয়া পড়াশোনার খরচ দেয়। শিক্ষকরাও সহযোগিতা করে। বাড়ি থেকে মাদ্রাসা অনেক দূরে হওয়ায় মা প্রতিদিন আসতে দিতে চান না। বিয়ের কথা বলে। কিন্তু মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশোনা করতে চাই। প্রতিবন্ধী বলে পিছিয়ে থাকব, এটা আমি মানতে পারি না।’

উপধাক্ষ্য এমদাদুল হক ও সহপাঠী শুকতারা জানান, ‘ছোট বেলায় গ্রামের ছেলেমেয়েরা যখন বই-খাতা নিয়ে বিদ্যালয়ে যেত। তখন সালমাও তাদের সঙ্গে গিয়ে বিদ্যালয়ে বসে থাকত। তার এই আগ্রহ দেখে তার ভাই সাইদুল তাকে ভর্তি করে দেন। এরপর ভাই তাকে বাড়িতে বসে পড়াশোনা করাতেন। মুখে পড়তে না পারলেও চোখ বুলিয়ে বিশেষ কায়দায় পাঠ্য বইয়ের পড়া আয়ত্ত করে নেন। তার হাতের লেখাও সুন্দর, ছবিও আঁকতে পারে। অভাবের সংসারে নিজের পড়াশোনা খরচ যোগাতে সম্প্রতি সালাম সেলাই কাজ শিখেছেন। কিন্তু টাকার অভাবে সেলাই মেশিন কিনতে পারছেন না।’

খাতায় লিখে পরিবারের মোবাইল নাম্বার চাইলে নিজের মায়ের নাম্বারটি লিখে দেন সালমা। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সালমার মা মমিনা খাতুন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘সালমা জন্ম থেইক্যা বোবা (বাকপ্রতিবন্ধী)। চিকিৎসা করানির পর ডাক্তার কইছিন ওর একটা কান ভালা আছে। চিকিৎসা করাইলে ভালা অইবো। কিন্তু টেকার অভাবে চিকিৎসা করাইতে পারি নাই। তিনি আরো বলেন, বাড়ি থেইক্যা সালমার মাদ্রাসা ছয় মাইল দূরে। অহন বোবা মাইয়্যারে একলা ছাড়তে ডর লাগে। আর অভাবের সংসারে ওরে (সালমা) লেহাপড়া করাইয়্যাই কী লাভ। ও কি কিছু অইতে পারব? ভালা একটা জায়গায় বিয়া দিতারলে সুখে থাকব। এইডাই অহন আমার স্বপ্ন।’

মায়ের সঙ্গে কথার রেশ টেনে ‘বড় হয়ে কী হতে চাও’ খাতায় লিখে প্রশ্ন করা হয় সালমাকে। উত্তর না লিখে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে সালমা। এরপর মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ থেকে সোজা চলে যায় শ্রেণিকক্ষে। মার্কার পেন দিয়ে ব্লাকবোর্ডে লিখেন, ‘আমি সালাম আক্তার। বাকপ্রতিবন্ধী। বড় হয়ে শিক্ষক হতে চাই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close