মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, সিলেট

  ১৭ মার্চ, ২০১৯

সিলেটে ‘নেশায়’ ধুঁকছে পথশিশু, জড়াচ্ছে অপরাধে!

‘ড্যান্ডি খাইলে মনের দুঃখ থাকে না, ক্ষুধাও লাগে না’

এই বয়সে ওদের বই-খাতা হাতে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা। ওদেরও স্বপ্ন আছে। আছে সাধ-আল্লাদ। তবে বাস্তবতা ওদের করেছে বিপথগামী। ওদের বেশির ভাগই বাবা-মা ও অভিভাবকহীন। পরিবেশ ও সমাজ ওদের দেখছে ভিন্ন চোখে। মরণনেশা ড্যান্ডিতে আসক্ত হয়ে তাদের জীবন এখন অন্ধকারের পথে। তাদেরই দুজন বিলাল ও রুমন। বয়স আনুমানিক ৯ বছর। বসবাস সিলেট রেলস্টেশন এলাকায়। তাদের নেশার জগতের আরেক সঙ্গী কাদের। বয়স আট। সেও তাদের মতো এখন ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের সঙ্গ দিয়ে থাকে সালাই ও জনি। প্রায়ই দলবেধে ওরা চলাফেরা করে সিলেট নগরের ক্বীন ব্রিজ, ফুটপাত ও রেলস্টেশন এলাকায়। কখনো আবর্জনার স্তূপ থেকে প্লাস্টিক, কাঁচের বোতল, লোহা থেকে শুরু করে ফেলে দেওয়া আরো অনেক কিছুই কুড়িয়ে বেড়ায় ওরা। বঞ্চিত শৈশবে সাময়িক সুখের প্রত্যাশায় অন্ধকারের চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছে এসব শিশুরা। ভয়াবহ হয়ে পড়ছে ওদের জীবন। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধজনক কর্মকা-ে। মাদক বহনের ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে এসব শিশু। চুরি-ছিনতাইয়েও জড়িয়ে পড়ছে; আবার এসবের টাকা ভাগাভাগি করতে গিয়ে ঘটছে খুনোখুনির মতো ঘটনা। এসব শিশু মাদকসেবীদের পুনর্বাসনে সরকারি কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। শিশু অধিকার আইনে এদের শাস্তির তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সহজেই এরা বিপথগামী হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এখনই এদের সুপথে ফিরিয়ে না আনলে বাড়বে অপরাধ। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমাজ ও দেশ। সন্ধ্যা হতেই নগরের বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন কিংবা সুরমা নদীর তীরে দেখা মেলে তাদের মতো আরো অনেক পথশিশুদের। বসে বসে সেবন করছে ড্যান্ডি নামক এই নেশাদ্রব্য। জুতা কিংবা ফোমে ব্যবহৃত সলিউশন (আঠা) পলিথিনে ভরে কিছুক্ষণ পরপর মুখের সামনে নিয়ে শ্বাস টেনে নেশা করে তারা। মাদক সেবনের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে খুনোখুনিরও ঘটনা ঘটছে। সরেজমিন শহরতলীর দক্ষিণ সুরমার রেলওয়ে স্টেশন এলাকার ডগেরপাড়, নগরের ক্বীন ব্রিজের নিচ, কুশীঘাট, কাষ্টঘর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কিছু পথশিশু বসে ঝিমাচ্ছে আর পলিথিন দিয়ে কী যেন করছে। আবার কেউ কেউ পলিথিনে শ্বাস নিতে মগ্ন। এটা কী জানতে চাইলে বলে, ‘ড্যান্ডি বানাইয়া খাই। এটি খাইলে মনের দুঃখ থাকে না, ক্ষুধাও লাগে না।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩০ থেকে ৪০ টাকায় এক ধরনের জুতার গাম কিনে শিশুরা। নগরীর প্রায় সব এলাকার দোকানেই এসব গাম পাওয়া যায়। পলিথিনের ব্যাগে আঠাল ওই পদার্থ নিয়ে কিছুক্ষণ ঝাঁকানো হয়। তারপর পলিথিন থেকে নাক বা মুখ দিয়ে বাতাস টেনে নেয়। এই নেশা ‘ড্যান্ডি’ নামে পরিচিত।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় কথা হয় দুই পথশিশুর সঙ্গে। তাদের একজন রুমন জানায়, তার মা-বাবার ঠিকানা সে জানে না। সে সারা দিন সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলার এলাকায় আবর্জনা থেকে কাগজ ও প্লাস্টিক কুড়িয়ে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করে। এরপর বিকেলে রেলস্টেশন এলাকায় বসে ড্যান্ডি নিয়ে। যেদিন টাকা কম হয় সেদিন গাঁজা সেবন করে। ক্বীন ব্রিজের নিচে কথা হয় ৯ বছরের শিশু কাদেরের সঙ্গে। সে বলে, আমার সঙ্গে থাকে রুমন, বাতিন, বিলাল। তারা সবাই আঠা (ড্যান্ডি) খায়, তাই ওদের দেখাদেখি আমিও আঠা খাই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ৮ থেকে ১০ বছর বয়সের শিশুরা সাধারণত গাঁজা, সিগারেট ও গাম সেবন করে। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সিরা ফেনসিডিল ও হেরোইন সেবন করে। মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর-তরুণদের নেশার অন্যতম উপকরণ ইয়াবা। তবে অধিকাংশ পথশিশু ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত। সিলেট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন মোল্লা জানান, জুতার আঠা নিষিদ্ধ কোনো বস্তু নয়। এ কারণে এ বিষয়ে কিছু করতেও পারছি না। সিলেটের অনেক পথশিশু এই নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। গাম যেহেতু আমাদের একটি প্রয়োজনীয় দ্রব্য তাই বিক্রি বন্ধ করা যাবে না। তবে আমাদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এটি যারা বিক্রি করেন তারা একটু সচেতন হলেই এ নেশা থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখা সম্ভব। সিলেটে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে ইচ্ছাপূরণ নামক একটি সংগঠন। সংগঠনের সভাপতি জান্নাতুল রেশমা রুমা ‘প্রতিদিনের সংবাদ’কে বলেন, পথশিশু সমাজের একটি অভিশপ্ত নাম। সমাজ এবং পরিবারের অবহেলার জন্য একটি নিষ্পাপ বাচ্চা সমাজে পথশিশু নামে পরিচিতি পায়। সমাজের সু-দৃষ্টি এবং সচেতনতাই পারে এসব বিপথগামী শিশুদের ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে। তিনি আরো বলেন, পথশিশুদের নিয়ে কাজ শুরুর পর থেকেই দেখেছি তারা বিভিন্ন নেশায় আসক্ত। তাদের অধিকাংশই ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ড্যান্ডি নেশায় আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট জেলা শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী এসব মাদকাসক্ত শিশুদের উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে বলেন, সমাজসেবা অধিদফতর, পুলিশ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এসব শিশুদের উদ্ধার করে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে পারে। অন্যথায় দেশ ও সমাজ ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলো এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। এ বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মো. জেদান আল মুসা বলেন, শিশু অধিকার আইনে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই কঠিন। এ বিষয়ে সর্বপ্রথম জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি সমাজসেবা অধিদফতর এসব মাদকাসক্ত শিশুদের উদ্ধার করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। প্রয়োজনে পুলিশ সমাজসেবা অধিদফতরকে সহায়তা করবে। এসব মাদকাসক্ত শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা না হলে এরা বিপথগামী হয়ে পড়বে। এরা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে সমাজ অন্ধকারের পথে চলে যাবে। কাজেই এদের রক্ষার্থে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close