নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

# মি টু : আন্দোলন

নারী নির্যাতন রুখতে এবার মুখ খুলতে হবে

লজ্জায়, ভয়ে মুখ লুকিয়ে থাকলে যৌন নিপীড়করা আরো অন্যায় করার সুযোগ পাবে, তাই নিপীড়িতদের সামনে আসার, মুখ খোলার আহ্বান এসেছে #মি টু আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে আয়োজিত এক মানববন্ধন থেকে। তারা বলেছেন আমাদের মুখ খুলতে হবে। নারী নির্যাতন রুখতে হবে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘মি টু মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ আয়োজিত এই মানববন্ধনে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক বলেন, ‘শুধু নারীরা নয়, ছোট ছোট ছেলেরাও নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে নির্যাতিত হয়। অনেক সময় ঘরেও তারা নিরাপদ নয়। এর বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। আপনি পুরুষ, কিন্তু আপনার মা একজন নারী, আপনার মেয়ে সন্তান থাকতে পারে। আপনার মেয়ে সন্তান না থাকলেও আপনার ভাইয়ের মেয়ে আছে, আপনার বোন আছে। নারীদের জন্য ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলুন। নারীর কর্মক্ষেত্র যেন সংকুচিত না হয়, নারীরা আরো সাহসী হয়ে তারা তাদের কাজের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে।’

ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, প্রশাসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠার প্রসঙ্গ তুলে ধরে নাসিমুন আরা বলেন, ‘কেউ আছেন অনেক ধনী, বড় সাহিত্যিক, অনেক মেধা, সমাজে তার অনেক অবদান। কিন্তু তার যতই অবদান থাক, যতই গুণী হোক, তিনি তো নারীর ওপর নির্যাতন করতে পারেন না। এই ধরনের অনাচার, অপরাধীর বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। আমরা যদি লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকি, তাহলে অপরাধীরা অন্যায় করে যাওয়ার সুযোগ পাবে। সে জন্য আমাদের মুখ খুলতে হবে। যারা মুখ খুলেছে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’

আগামীকাল রোববার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করার ঘোষণা দিয়ে নাসিমুন আরা বলেন, ‘আগামীতেও এ আন্দোলন চলবে। তিনি বলেন, অভিযোগ আসার পর কয়েকটি সংগঠন দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে, এই ধরনের সচেতনতা যেন সব প্রতিষ্ঠানেই থাকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের হয়রানির শিকার হওয়ার চিত্র তুলে ধরে নাসিমুন আরা বলেন, ‘যেখানেই ঘটনা ঘটবে, সেখানেই যেন আমরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি, অ্যাকশন নিতে পারি।’ সব সংবাদমাধ্যম, সব করপোরেট প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে তিনি বলে, ‘সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কমিটি করতে হবে। সরকারের কাছে আমাদের আহ্বান, হাই কোর্টের রায়কে আইনে পরিণত করুন।’

নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি বলেন, হাজার বছর ধরে যে পশ্চাদপদ মন, সেই অন্ধকার একদিনে দূর হবে না। কিন্তু সবাই মিলে চেষ্টা করলে সেই অন্ধকার তাড়াতাড়ি দূর হবে। সেই কাজটা আমাদের শুরু করতে হবে। নারীকে শ্রদ্ধা করতে হবে, কারণ নারীরাও এ দেশের নাগরিক।’

২০০৬ সালে আফ্রো আমেরিকান সামাজিক আন্দোলনের কর্মী তারানা বুরকি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের বিষয়ে প্রথমবারের মতো ‘মি টু’ ধারণার কথা বলেন, পরে একই নামে একটি প্রামাণ্য চিত্রও নির্মাণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় পরে হলিউড অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #মি টু আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এরপর একে একে মুখ খুলতে থাকেন হলিউডের অভিনেত্রীরা। নীরবতা ভেঙে যৌন নিগ্রহের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান দিতে থাকেন নারীরা।

এরপর এর ধাক্কা এসে লাগে ভারতে। শুধু রুপালি জগতেই নয়, রাজনীতিসহ অন্যান্য মাধ্যমেও যৌন নিপীড়নের কথা মুখ ফুটে বলতে শুরু করেন তারা। সম্প্রতি বাংলাদেশের নারীরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হ্যাশ ট্যাগ মি টু’তে তাদের নিপীড়নের কথা বলতে শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় ‘মি টু মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামে এই সংহতি সমাবেশ।

বাংলাদেশ উইমেন জার্নালিস্টস ফোরামের সভাপতি মমতাজ বিলকিস মানববন্ধনে বলেন, ‘সব সম্পাদকের কাছে অনুরোধ করব, তারা যেন একটা কলাম এই মি টু’র জন্য রাখেন যেন মেয়েরা তাদের মনের কথাগুলো ইচ্ছেমতো বলতে পারে, সমাজকে সচেতন করার পদক্ষেপ তারা নিতে পারে। লজ্জা ঢেকে রাখার প্রথা পরিবর্তন করতে হবে। এজন্য সংবাদপত্রকে বিষয়টি অনেক গুরুত্ব দিতে হবে।’ উইমেন জার্নালিস্টস ফোরামের সভাপতি বলেন, ‘#মি টু’ পুরুষবিরোধী কোনো আন্দোলন নয়। এটা সমাজকে ‘কীটমুক্ত’ করার আন্দোলন। বাংলাভিশনের বার্তা সম্পাদক শারমিন রিনভী বলেন, ‘ঘটনাটি লজ্জার বলে সবকিছু চাপিয়ে রাখলে নিপীড়ন বাড়বে এবং বাড়ছে। এটা মেয়েদের নয়, মানুষের আন্দোলন। যারা নিপীড়ন করছে, তাদের পরিচয় উন্মোচন হোক।’

একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার কথা তুলে ধরে রিনভী বলেন, ‘তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন বলে শোনা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুরোধ, তাদের প্রার্থী করবেন না। নিপীড়ক যেখানেই থাকবে তাদের বয়কট করতে হবে।’

যারা সাহস করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যৌন নিপীড়ন নিয়ে কথা বলছেন, তাদের অভিনন্দন জানান নিউজ টোয়েন্টিফোরের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক আঙ্গুর নাহার মন্টি।

তিনি বলেন, ‘শুধু মেয়ে না, ছেলেদের উপরও যৌন নির্যাতন হয়। তাই আমার প্রত্যাশা, দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষ এই আন্দোলনে থাকবেন।

সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার সাংবাদিক নাদিরা দিলরুবা সংহতি মানববন্ধনে অংশ নিয়ে জানান, ১০ বছর বয়সে মায়ের চাচাত ভাই জালাল উদ্দিনের হাতে যৌন নির্যাতনের ঘটনা তিনি হ্যাশ ট্যাগ মি টু’তে লিখেছেন। বিবেকের তাড়নায় মি টু’তে লিখেছেন জানিয়ে নাদিরা বলেন, ‘আমরা পরিবার থেকেই প্রথম যৌন নিপীড়নের শিকার হই।’

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শুক্কুর আলী শুভ তার সংগঠনের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনে সংহতি জানান। বাংলাদেশ সংসদ সদস্য সংস্থার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কবির আহমেদ খান এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন। সমাপনী বক্তব্যে বাংলা ট্রিবিউনের প্রধান প্রতিবেদক উদিসা ইসলাম বলেন, ‘মি টু আন্দোলনে অভিযুক্তের বিষয়ে ডেইলি স্টার প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। আমরা চাই আরো যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিষ্ঠান যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’ অন্যদের মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক এফ এম শাহীন, বাংলাদেশ অনলাইন জার্নালিস্ট ফোরামের সহ-সভাপতি রোজি ফেরদৌস সমাবেশে বক্তব্য দেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close