অরূপ তালুকদার

  ২৬ মার্চ, ২০১৮

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র : মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট

একাত্তরে অনেক ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে আমি আর আমাদের পরিবারের বাবা, মা, ভাই, বোনসহ ছজনের দলটি যখন কলকাতায় পৌঁছালাম, তখন জুলাইয়ের শেষ। উঠলাম গিয়ে নৈহাটীতে আমার আপন ছোট বোনের বাসায়। এর আগে তিন দিন চাররাত পার করে আমরা যেদিন পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন লাগোয়া মৎস্যবন্দর ঝড়খালীতে এসে পৌঁছলাম, সেদিন আবার যেন নতুন করে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা মনের ভেতরে জেগে উঠেছিল। কারণ তার আগের দু-তিন মাস দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত এক গ্রামের বাড়িতে যে ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে দিন কেটেছে, সেখান থেকে কোনোদিন আর জীবন নিয়ে বেরুতে পারব, তেমন আশা ছিল না।

তবে শেষ পর্যন্ত খোঁজখবর করে মঠবাড়িয়া থেকে রেয়াজউদ্দিনের নৌকার যাত্রী হয়ে শেষ সম্বলটুকু হাতে নিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা করেছিলাম। বলতে গেলে, সুন্দরবনের গভীর অরণ্যের ভেতর দিয়ে সেই নৌকা আমাদের পৌঁছে দিয়েছিল ঝড়খালীতে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চার-পাঁচ দিনের সেই নৌযাত্রার মধ্যে দেশের ভেতরে ঢোকার প্রতীক্ষায় সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা পাওয়া সে আরেক ইতিহাস।

কলকাতায় আসার পরে একেবারে অজানা-অচেনা পরিবেশে, অচেনা মানুষজনের মধ্যে শুরু হলো আরেক কঠিন জীবনযাত্রার পালা। কোথায় যাব, কী করব, কীভাবে কাটবে ভবিষ্যৎ জীবন। এমন চিন্তাভাবনা আমাদের বাবা-মাকে যেমন অস্থির করে তুলেছিল, তেমনি বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে আমাকেও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছিল। ফলে ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে পারতাম না। সারাদিন এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতাম, প্রায় সময়ই উদ্দেশ্যহীনভাবে। এ সময়ে যাদের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে, তারা ছিল সহানুভূতিশীল। শিয়ালদহ ট্রেন স্টেশনের কাছে একটা বেশ বড় কাপড়ের দোকানের মালিকের ছোট ছেলের সঙ্গে একদিন আলাপ পরিচয় হওয়ার পরে মাঝে মাঝে সেখানেই বসতাম গিয়ে। কখনো কখনো স্টেশন চত্বরে ঘুরতাম অহেতুকভাবে। সেখানে মাঝে মাঝে দেখা পেতাম দেশ ছেড়ে আমাদের মতো উদ্বাস্তু হয়ে আসা বহু মানুষের। তাদের মধ্যেও চেনা মানুষের খোঁজ করতাম। তাদের কথা মনে পড়লে এখনো চোখ জলে ভরে যায়। মনটা বেদনার্ত হয়ে পড়ে। শিয়ালদহ ট্রেন স্টেশন থেকে হাঁটাপথ দূরত্বে ছিল সে সময়ের শ্রীনিকেতন হোটেল। শুনেছিলাম এ হোটেলে আমাদের দেশের অনেক মানুষের যাতায়াত আছে। কী ভেবে একদিন চলে গেলাম শ্রীনিকেতন এবং সত্যি সত্যিই সেখানে অনেক মানুষের দেখা পেলাম, যাদের মধ্যে নেতাগোছের কেউ কেউ ছিলেন। সবাইকে দেখেছিলাম নানাভাবে ব্যস্ত। কেউ আসছেন, কেউ যাচ্ছেন। কেউ একা, কেউ সদলে। এদের কথার ভাষা শুনে বোঝা যাচ্ছিল কেউ চট্টগ্রামের কেউ সিলেটের, কেউ বা অন্য কোনো জেলার। আমি এদের মধ্যে খুঁজছিলাম আমাদের বরিশালের বা খুলনা এলাকার মানুষজন। তবে আমার খোঁজা বিফল হলো না। তৃতীয় দিনেই পেয়ে গেলাম খুলনার অমিয় দাসকে। তার কাছ থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরটিও পেয়ে গেলাম। সে আমাকে, তার নানা কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও পরদিন বেলা ১১টার দিকে ট্রামে করে গিয়ে নামিয়ে দিল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের মুখে। বলে দিলেন, এখান থেকে পনেরো বিশ মিনিটের হাঁটাপথে পাওয়া যাবে। সেই দোতলা বাড়িটি যেখান থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালিত হয়। কোয়ালিটি আইসক্রিমের একটা বিরাট সাইনবোর্ড পেছনে রেখে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড ধরে প্রায় আধঘণ্টা হেঁটে আন্দাজ করে একটা দোতলা বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। কোথাও কিছু লেখা দেখলাম না। কিছু দূরে দেখলাম একটা অতি সাধারণ দেহাতি চা-বিস্কুটের দোকান। তার সামনে বসে বা দাঁড়িয়ে কেউ কেউ চা-সিগারেট খাচ্ছে, কথাবার্তা বলছে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। কাউকে জিজ্ঞেস করে যদি খোঁজখবর পাওয়া যায়।

একপাশে চার-পাঁচজন মিলে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। তাদের মধ্যে একজনকে একটু চেনা মনে হচ্ছিল। হলেও হতে পারেন তিনি সমর দাস। পুরোনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে থাকতেন। ভালো গীটার বাজান। তার সঙ্গে একবার আলাপ হয়েছিল এক অনুষ্ঠানে। পরে তাকে আমাদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানেও এনেছিলাম। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ঠিক চিনলেন। কথাবার্তা হলো। পরে তিনিই আমাকে নিয়ে এলেন বেতার কেন্দ্রের ভেতরে। পরিচয় করিয়ে দিলেন সামনে যাকে যাকে পেলেন সবার সঙ্গে। সেদিন কামাল লোহানী, আশরাফুল আলম, সুব্রত বড়–য়া, আবদুল জব্বার, অনু ইসলাম, আমিনুল হক বাদশাসহ অনেকের সঙ্গেই দেখা আর কথাবার্তা হলো।

সেই থেকে শুরু। তারপর প্রায় প্রতিদিনই যাওয়া-আসা করতে থাকলাম বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের স্বল্প পরিসর বেতার কেন্দ্রটিতে। কখনো কখনো মনে হতো, কী যে অমানুষিক পরিশ্রম করছেন এখানে কর্মরত সবাই। ঠিকভাবে বসার জায়গা নেই, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। রাতে যারা এখানেই থাকেন তারা কীভাবে রাত্রিযাপন করেন, সেটা আর বলার নয়। তবু কী অদম্য উৎসাহ, প্রেরণা আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন সবাই। কারো কোনো অভিযোগ নেই, না পাওয়ার বেদনা নেই, হতাশা যা ছিল তা মিলিয়ে গেছে ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে। প্রায় দিনই কিছু না কিছু লিখে আনি যার বেশির ভাগই কথিকা, কখনো কখনো কবিতা। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা পেলাম কবির ভাইয়ের (আলমগীর কবির) যিনি প্রয়াত হয়েছেন এক সড়ক দুর্ঘটনায় বেশ কয়েক বছর আগে। বললেন, ইংরেজিতে কিছু লিখতে। তিনি তখন ইংরেজি বিভাগের দায়িত্বে।

লিখলাম। উৎসাহের যেন শেষ নেই। তার তাড়াতেই যথেষ্ট পরিশ্রম করে তৈরি করতাম একের পর এক ইংরেজি কথিকা। আর বাংলায় পাঠ করতাম কবিতা। কবির ভাইয়ের উৎসাহে একবার তিনপর্বের কথিকা ‘দ্য ডাইং পাপেট স্টেট’ প্রচারিত হয়েছিল। যাতে ছিল সে সময়ের পাকিস্তানের অন্তিম অবস্থার বিবরণ আর পর্যালোচনা ।

এ সময়ে নৈহাটী থেকে চলে যাই হাবড়ায় এক বন্ধুর বাড়িতে। সেখান থেকে শুরু হয় প্রতিদিন কলকাতায় যাওয়া-আসা। সকালে যাই, ফিরে আসতে আসতে রাত। ফিরে এসে আবার লেখা তৈরি করা। এ ব্যাপারে বন্ধুর উৎসাহ ছিল প্রচুর। ফলে মনের জোরটা আরো বাড়ত। অথচ কী কঠিন সময় ছিল তখন। আয় উপার্জন বলতে সামান্যই, যা জীবন ধারণের জন্য ছিল অতি নগণ্য। দিনের পর দিন পাজামা-পাঞ্জাবি পরেই চালিয়ে দিতাম। অন্য কোনো পোশাক ছিল না। মনে আছে, একবার নভেম্বরের দিকে রেডক্রস থেকে কিছু টাকা পেয়েছিলাম। সে টাকা দিয়ে এক শ টাকা দামের একখানা শাল কিনেছিলাম শীতের কথা ভেবে। সেই চাদরটি এখনো আছে। যতœ করে রেখে দিয়েছি সেদিনের স্মৃতি হিসেবে। এভাবে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে, নানা পত্রপত্রিকায় লিখে একাত্তরের সেই নির্মম দিনগুলো কাটছিল আমাদের। কত মানুষের সঙ্গে তখন কতভাবে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সেসব আজ স্মৃতি। দীর্ঘ সময়ের পর ধূসরতায় ম্লান হয়তোবা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist