নাজমুল হক ইমন

  ২৫ আগস্ট, ২০১৭

প্রাচীন আলোয় কুমিল্লা

জনপদের নাম কুমিল্লা। গোমতী পাড়ের শহর। ত্রিপুরার রাজারা এক সময় এ শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপন কেন্দ্র হিসেবে। গোমতী পাড় বলে এ জনপদের সুখ্যাতি রয়েছে। ব্যাংক ও ট্যাংকের (পুকুর) শহর কুমিল্লা। তার পাশঘেঁষে গড়ে উঠেছে কমলাংক বা বর্তমান কুমিল্লা। দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন আয়তনের একটি দেশ হলেও পর্যটনশিল্পের বিচিত্র শাখায় সমৃদ্ধ এ জেলা। বিরল সৌন্দর্য ও সভ্যতার আদি নিদর্শন এ অঞ্চলের মানুষের বর্ণাঢ্য জীবনধারা প্রকৃতির এ রূপ দেশি-বিদেশি ভ্রমণবিলাসীদের চিরকাল আকর্ষণ করেছে। কুমিল্লা শহরের বুকজুড়ে রয়েছে আদি নিদর্শন শালবন বিহার, রূপবানমুড়া, ইটাখোলামুড়া, ময়নামতি ঢিবি, রানির বাংলো, ময়নামতি জাদুঘর আরো আছে অপূর্ব প্রাকৃতিকঘেরা সবুজ বৃক্ষবেষ্টিত লাল মাটির লালমাই পাহাড়।

প্রাচীন সভ্যতার নীরব সাক্ষী ময়নামতি লালমাই

কুমিল্লা শহর থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। টিলাগুলোর উত্তর অংশে ময়নামতি, দক্ষিণে লালমাই মাটির রং লাল ও টিলাগুলো ঢালু। ১৮৭৫ সালের আগ পর্যন্ত সব ছিল অজানা। বর্তমান কোটবাড়ি এলাকার রাস্তা তৈরির সময় ছোট ইমারতের ধ্বংসাবশেষে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ভূমির ওপর অসংখ্য কাঠের ফসিলের টুকরো দেখতে পাওয়া যায়, যা ভূমন্ডলীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। ১৯১৭ সালে অধ্যক্ষ নলিনী কান্ত ভট্টশালী রনবংকমল¬ হরিকেল দেবের তা (খ্রিস্টীয় তেরো শতক) উল্লেখিত দুর্গ বিহার পরিবেষ্টিত পট্টিকরা নগর বলে শনাক্ত করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ও জরিপের ফলে মূল্যবান স্থাপত্যকে নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়।

শালবন বিহার

কালিবাজার সড়ক ধরে কুমিল্লা শহর থেকে কোটবাড়ি এসে দক্ষিণ দিকগামী রাস্তা দিয়ে ১.৫ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে শালমানপুর গ্রামে পৌঁছার পর হাতের বামে শ্রী ভবদেব মহাবিহার। কালের পরিক্রমায় গ্রামের নামানুসারে শালবন বিহার নামকরণ হয়। তবে সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে যেটা পাওয়া যায় ১৯৫৫-৬৮ সাল পর্যন্ত খননকাজ পরিচালনার ফলে ছয়টি বসতি আমলে চিহ্নের সন্ধান পাওয়া যায়। বিহারের ভেতর প্রবেশের জন্য উত্তর বাহুর মাঝখানে একটি তোরণ আছে। খোলা চত্বরের মাঝখানে বিহারের তোরণের সিঁড়ি থেকে দক্ষিণে কেন্দ্রীয় মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরটি ক্রুসাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত। এই মন্দির পরিকল্পনাকে ইন্দোনেশিয়ার জাভায় অবস্থিত কলসন মন্দির (৭৭৮ খ্রি.), মিয়ানমার প্যাগানের আনন্দ মন্দির (১০৯০ খ্রি.) এবং বাংলাদেশের সোমপুর বিহার, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের স্থাপত্যকলার উৎস সূত্র হিসেবে গণ্য করা যায়। প্রদক্ষিণ পথের সঙ্গে খামওয়ালা হলঘর সিঁড়ি গলিপথ ভজনালয় এবং ভজনালয় কোটাটিতে কুলিঙ্গসহ আসনের সংস্থান আজও অক্ষত রয়েছে। হলঘরের দক্ষিণে মূর্তি কোটার অবস্থান এবং রাখার জন্য বেদিও ছিল। চারপাশে রয়েছে প্রদক্ষিণ পথ। কালের পরিক্রমায় মন্দিরের পরিসর কমে আসে। উল্লেখ্য, প্রত্যেক আমলে মন্দিরে ঢোকার জন্য উত্তর দিক থেকে সিঁড়ি ব্যবস্থা এবং চারপাশে ঘেরার উপযোগী পথের অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমান করা যায়।

বার্ড

এখানে ঘুরতে আসা অনেক পর্যটকই বার্ড-এর নাম শুনলে ভাবেন এখানে অনেক অনেক পাখি থাকবে। যেমন নাম তেমনটা হওয়া উচিত। এর আশা দুই-ই। ছায়া সুনিবিড় মমতাঘেরা রাস্তা। দুই পাশে নানা রকমের নানা রঙের ফুল ও ফলের বাগান। পাখির কুজন আর ফুলের গন্ধে চারদিক ঘিরে রেখেছে বার্ডকে। বিস্তর সবুজের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে কৃষ্ণচূড়া আর রঙ্গন। এ অপরূপভার গড়ে তোলেন ড. আখতার হামিদ খান। বার্ড মূলত বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষের প্রশিক্ষণ একাডেমি।

ওয়ার সিমেট্রি

১৯৪১-৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৭৩৭ জন সৈনিকের সমাধি ক্ষেত্র ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। সবুজ বনানী আর ফলে ফুলে ভরা বাগান ও বিশালকার স্তম্ভ। আশ্চর্য এবং লক্ষণীয় বিষয় এই, বেশির ভাগ সৈনিকের বয়স ছিল ২০-২২ বছর। জীবনের শুরুটা যখন, ঠিক তখনই যুদ্ধে মহীয়ান এসব বীর সৈনিক। দেখা যাবে শহরের শুরুতেই যাওয়ার পথে রাস্তার বাম দিকে।

ময়নামতি জাদুঘর

বাংলাদেশে বেশকটি জাদুঘর আছে তার মধ্যে ময়নামতি জাদুঘর উল্লেখযোগ্য। এ জাদুঘরে স্থান পেয়েছে (খ্রি. অষ্টম শতাব্দীর) শ্রী ভবদেব মহাবিহার, কোটিলামুড়া, চাপত্রমুড়া, রূপবানমুড়া, ইটাখোলামুড়া আনন্দ বিহার, রানরি বাংলো ও ভোজ রাঙার বাড়ি ইত্যাদি থেকে উদ্ধারকৃত মূল্যবান পুরাবস্তু। জাদুঘরটি আকারে নির্মিত এবং পাশে বিশ্রামাগার আছে ও ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা সবুজে সবুজে।

ইটাখোলামুড়া

উত্তর-পশ্চিম কালিবাজার সড়কের সংলগ্ন উত্তর কোটবাড়ি এলাকায় অবস্থিত। পাশাপাশি দুটি প্রাচীন প্রতœস্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এগুলো একটি মন্দির ও অপরটি বিহার। আবিষ্কৃত পুরাবস্তুগুলোর মধ্যে চুনবালিজাত উপকরণে তৈরি একটি বড় আকারে লোকত্তর বৃদ্ধ (আবক্ষ অংশ ব্যতীত) আজও বিদ্যমান। রূপবানমুড়া ইটাখোলামুড়ার দক্ষিণে কালিবাজার সড়কের ওপারেও রূপবানমুড়া। টিলাটি সড়কপথ থেকে ১১ মি. উঁচুতে। তিনটি বসতি আমলের অস্তিত্ব রয়েছে এই শৈলীতে। রূপবানমুড়া ক্রুসাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত। পেছনের অংশটি মূর্তিকোঠা এবং সামনেরটি মন্ডপ। মূর্তির চারদিকে ঘোরানো পথ আছে। প্রতমানের বিচারে মন্দির ও বিহারটি খ্রি. অষ্টম শতাব্দীর নির্মিত, যা আজও কালের সাক্ষী।

ধর্মসাগর

ত্রিপুরা রাজ্যের অধিপতি মহারাজ ধর্ম মানিক্য ১৪৫৮ সালে জনগণের পানি ও জলের সুবিধার জন্য এ দিঘি খনন করেন। দিঘির একপাশে তা¤্রলিপি পাঠ আছে ফলকে। বিশ্রামের জন্য রয়েছে বেদি, যা অবকাশ নামে পরিচিত। দিঘিটির বাম পাশঘেঁষে রয়েছে ড. আখতার হামিদ খানের বাংলো, যা রানিকুঠির নামে পরিচিত। এ ছাড়াও রয়েছে যার অবদানে বাংলা আজ বাংলা নামে পরিচয় এমন কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি, বিপ্লবী অতীন্দ্র মোহন সেনের বাড়ি এবং রয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের অনেক স্বাক্ষর। বলা যায় শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির পাদপীঠে কুমিল্লা প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হিসেবে এ উপমহাদেশে সুপরিচিত। এ ছাড়াও রয়েছে তার ব্যাংক, ট্রাংক রোড নাম, খাদিশিল্প, তাঁত কুঠির, মৃত কারুশিল্প, রসনা তৃপ্তির জন্য রসমালাই আর রয়েছে ভালো লাগার শীতলপাটি; যা আজও আপন আলোয় শহরটিকে সমৃদ্ধ করেছে। কুমিল্লায় বিভিন্ন স্থানে যেতে যেতে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যের মুখোমুখি হবেন আপনি। এভাবে কেটে যাবে অনেকটা সময়। অবসরযাপনের এমন চমৎকার জনপদ

কুমিল্লা।

যেভাবে যাবেন

ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে একাধিক বাস ছেড়ে যায় কুমিল্লার স্টেশন শাসনগাছার উদ্দেশে। ভাড়া ২০০-২৫০ টাকা। তারপর সেখান থেকে আপনি সহজেই যেতে পারবেন এসব দেখতে। থাকা-খাওয়া নিয়ে ভাবতে হবে না। তারও সুব্যবস্থা রয়েছে। তবে ফেরার সময় মাতৃ ভান্ডারের রসমালাই আনতে ভুলবেন না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist