বিমল কৃষ্ণ রায়

  ১৮ আগস্ট, ২০১৭

‘পশুর নদীতে মুখ দেখেছি সকাল বেলায়’

কবি দিলীপ কির্ত্তুনিয়ার কাব্যগ্রন্থ ‘পশুর নদীতে মুখ দেখেছি সকাল বেলায়’ দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে চল্লিশটি কবিতার সমন্বয়ে গ্রন্থিত। কবি পৃথিবীকে রঙের কৌটা, দাড়ি, কমা, সেমিকোলন, ড্যাশের সঙ্গে তুলনা করে নিয়মকানুনের আগড়ে আবদ্ধ বৈচিত্র্যময় জীবনপ্রবাহ, জীবনের গতিপ্রকৃতির প্রতিটি বাঁককে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। কবির উপস্থাপনা এভাবেই, ‘পৃথিবীটা দাড়ি কমা/সেমিকোলন ড্যাশ/পৃথিবীটা ব্যাকরণ বইতে থাকে।’ (পৃথিবীটা, পৃষ্ঠা ৯) মানুষের জীবনে অব্যক্ত থাকে অনেক কিছুই। সব কথা না বলা যায়, না বলতে পারে কেউ?

কিছু কথা হৃদয়ের গভীরে দাগ কাটে। কবির ভাষায়-‘কিছু কথা লেগে থাকে আঠার মতন/কিছু কথা খোদাই হয়ে যায় পাথরে।/কিছু কথা বর্ষার জল-গড়ায় দেয়ালে দেয়ালে।’ আবার, ‘এখনো অনেক কথা হয়নি বলা-/যেমন পথ বাকি- /পথের চলা।’ (কথা কিছু, পৃষ্ঠা ১০) তিনি দুঃখ-কষ্ট-মৃত্যুকে অবলোকন করেছেন খুব কাছে থেকে, মানব মনের গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। তার কবিতায় জীবন-মৃত্যুর উপমা এসেছে এভাবেই, ‘অনেকটা আতশবাজির এক হলকার মতো।/অনেকটা এক দুপুর-এক বিকেল-এক রাত্রি/হঠাৎ ভোরবেলায় দেখি তিনি নেই।’ (অনেকটা, পৃষ্ঠা ১২)

তিনি বিভিন্ন উপমার প্রয়োগে মনকে উপস্থাপন করেছেন তার ‘দূরত্ব’ কবিতায়। তার কবিতায় এসেছে ভেলোর সিএমসি এইচ হাসপাতালের কথা। এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেন বলেই তিনি তার কবিতায় এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর কথা, ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের কথা, সাতই মার্চের ভাষণের কথা। কবিতার ভাষায়, ‘একাত্তরে কেউ একা ছিলাম না/একা শব্দটা হারিয়ে গিয়েছিল/একাত্তর সালে।... যুদ্ধে যাওয়ার ডাকে।/মুক্তিযোদ্ধার দলে, প্রতিরোধের দলে/ভিড়েছিলাম একাকিত্ব ছুঁড়ে দিয়ে। ... সেই একাত্তর-একাহীন কাল/এক হয়ে থাকার মুগ্ধ সময় এখন চেতনায়/দীপ শিখার মতো জ্বলে। (এখন চেতনায়, পৃষ্ঠা ১৫)

‘কথা’ কবিতায় কবি জীবনকে কথার সমষ্টি হিসেবে এবং প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘জীবন সমুদ্র-কথা জল তার/জীবন উদ্ভিদ-কথা পাতা তার/পৃথিবীতে বিচিত্র বর্ণ ফুল/ফুল নয় কথার বাহার।’ (কথা, পৃষ্ঠা ১৭) তিনি মহাভারতের দ্রুপদী চরিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যা সত্যিই তার শুদ্ধ মননশীল মনের পরিচয় বহন করে। কবির উচ্চারণ- ‘দ্রুপদীর ছিল পাঁচ স্বামী/হাতের পাঁচ আঙুল।... বছর শেষে/আগুনে পুড়ে শুদ্ধ হতো দ্রুপদী/এর কি মানে।/এর একটাই মানে/দ্রুপদী জন্মগ্রহণ করেছেন পাঁচবার/আর পঞ্চপান্ডব পাঁচ সময়ের মানুষ/অথবা একটি শরীরে/পাঁচটি সত্তা। (আগুনে পুড়ে, পৃষ্ঠা-১৮) প্রেমিক কবি তার প্রেমের নৈবেদ্য থরে থরে সাজিয়েছেন তার কবিতায়, পাঠিয়েছেন প্রেমিকার কাছে। তাতে ও তার তৃপ্তি হয়নি শেষ পর্যন্ত নিজেকে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন-এমনই উচ্চারণ তার কবিতায়। কবির ভাষায়, ‘এভাবেই আমি একদিন পোস্টাপিসে পোস্ট করে/একটি পুকুরকে পাঠালাম/সেখানে কত মাছ ছিল জানো?/এবাবেই আমি ফুলকে পাঠাই তোমার কাছে-/ঘরের ভেতর ভেঙে যাওয়া কাঁচের দৃশ্যকে পাঠাই/তোমার কাছে।/... আমার ঘরের জানালায় নামা কষ্টের রাত/বৃষ্টি কøান্ত বিকেল, সব পাঠাই তোমার কাছে।/এতেও কি তুমি আমার দুঃখকে ছুঁতে পারো?/আমার ভলোবাসাকে?/তোমার প্রতি আমার কুশল কামনাকে?/হয়তো পারো-হয়তো পারো না।/প্রতি উত্তরে কোনো দিন লেখনি যে কথা/দেখবে, আমি নিজেই একদিন/পোস্ট হয়ে চলে এসেছি তোমার কাছে/সবশেষ চিঠি।/(চিঠি মালা, পৃষ্ঠা নং-২৫) বিরহ, প্রেম, করুণ-আকুতি, একাকিত্বের অন্ধকার, গভীর শূন্যতা যথাক্রমে ‘একা থাকা, কেন, আমার পরাণটা, বেদনাবাড়ি, খারাপ কাজ’ কবিতায় ফুটে উঠেছে। ‘কান্নার মতো হাসির মতো, কিছু খুচরো কবিতা, মানুষ সবচেয়ে নিজেকে বেশি দেখে, যেখানে যা সম্মত, একাই নির্ধারণ করে দেব, মাটির পুতুল, সময়টাকে মনে হচ্ছে-এটাই আকাশের, পাখিদের উড়ে যাওয়া, জ্বালা জানাতে, ঘরে ফসল তুলে, যখন আলো জ্বলে, হিসাব-নিকাশ, যেখানে পাখি আছে, দুই দিকে গেছে চলে, লাশ, ঘরের মধ্যে অদৃশ্য কাচগুলি, ভাবছি বলেই, কবিতার রেললাইন ধরে’ কবিতাগুলো দার্শনিক মনোভাব, অন্তর্দৃষ্টি ও গভীর জীবনবোধে ভরপুর। আমার বিশ্বাস কবিতাগুলো পাঠক হৃদয়কে নিঃসন্দেহে আলোড়িত করবে।

পশুর নদীতে মুখ দেখেছি সকাল বেলায়

দিলীপ কির্ত্তুনিয়া

প্রকাশক : খড়িমাটি, কদম মোবারক লেইন মোমিন রোড

চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।

প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর।

প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি-২০১৭

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist