বাণী বসুর আত্মকথন
যাপনের একঘেয়েমি গ্রাস করেছে সাহিত্যকে
আমার ছোটবেলা কিন্তু এখনকার বাচ্চাদের থেকে অনেকটাই আলাদা কেটেছে। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে। জ্যাঠতুতো, মামাতো, নিজের ভাইবোন মিলে হই হই করে কেটেছে দিনগুলো। আজকালকার বাচ্চাদের মতো এত পড়াশোনার চাপ আমাদের ছিল না। যদিও আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে তিন-চারজন ছিল খুবই মেধাবী। তাই আশা করা হতো আমরা বাকিরাও ওই করম হব। কিন্তু এসবে কখনোই খুব একটা পাত্তা দিইনি।
মনে আছে, খবর এলো আমার ছোটদি, গৌরী চৌধুরী (এখন ধর্মপাল) ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। তখন ছোটদি ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। সেই থেকে আমাদের একটা ধারণা জন্মেছিল, সহজেই বুঝি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া যায়। এজন্য আলাদা কিছু পড়াশোনা করতে হয় না। আর পাঁচটা বাচ্চার মতো মারধর খেয়েছি। তবে মা-বাবার থেকে দাদা-দিদিদের শাসনই চলত ছোটদের ওপর বেশি।
ছোটবেলার কথা বলতেই কতকগুলো টুকরো ছবি ভেসে ওঠে। মনে পড়ে বড়ি দেওয়া। বাড়ির ছোটরা বসে দেখতাম পুরোটা। ডাল বাটা ফাটানো, তাতে হিং দেওয়া চালকুমড়ার কুচি মেশানো। তারপর শাঁখ বাজিয়ে সে বাড়ির ছাদে শুকাতে দিতে যাওয়া হতো। পিছু ধরতাম ছোটরা। ছাদে ছিল পায়রার ব্যোম। খুঁটির ওপর ছিল সে ব্যোম। এ থেকে দুটো বড় বড়ি দেওয়া হতো বলতাম, কুড়ো বুড়ি। তাদের সিঁদুর পরিয়ে ধান-দুব্বো দেওয়া হতো। ওই দুটো বাড়ির কর্তা-গিন্নিরই খাওয়ার কথা। কিন্তু দুটোর ওপর আমাদেরই লোভ থাকত বেশি। মা-বাবা সেটা বুঝতেন। তাই খেতে বসে সেই বড়ির ভাগ কোনো না কোনোভাবে আমাদেরও জুটত। আর তার স্বাদ যে কী অপূর্ব, এখনো মুখে লেগে আছে।
আমার মা খুব সুন্দর ফ্রক বানাতে পারতেন। লেসজুড়ে, কখনোবা চিকনের কাজ করা এলাইনের ফ্রক তৈরি করে দিতেন আমাদের। বাহুল্য ছিল না তাতে, কিন্তু তার আকর্ষণকে তা বলে খাটো করা যায় না। মনে আছে, একবার ম্যাগাজিনে রাজকুমারী এলিজাবেথ আর মার্গারেটের ছবি দেখে, সে ধাঁচের ফ্রক তৈরি করেছিলেন মা আমাদের জন্য। পাড়ায় একটা হইচই পড়ে গিয়েছিল সেবার পূজায়। সবাই এসে মাকে ধরত আমাদের মতো জামা বানিয়ে দেওয়ার জন্য। মাও দিতেন যতটা সম্ভব হতো।
প্রতিটি শীতে আমাদের সবার জন্য মামাবাড়ি থেকে আসত আমসত্ত্ব। ভাইফোঁটা, অষ্টমী-এসব দিনে জোরভোজ হতো। পৌষসংক্রান্তির রাতে পিঠে ছাড়া অন্য কিছু খেতাম না। পিসিমা খুব ভালো পিঠে তৈরি করতেন মুগ সামালি, কড়াই শুঁটির ভাজা পিঠে, সরু চাকলি, রসবড়া, আরো কত কী! আমি বেশি মিষ্টি খেতে পারতাম না বলে আমার জন্য রাখতেন ভাজা মালপোয়া। পিসিমা খুব ভালো খাজাও বানাতে পারতেন। বোনদের বিয়ের পর সবার শ্বশুরবাড়িতে খাজা পাঠানো হতো। আমার বিয়ের পরও এসেছিল।
ছোটবেলায় আশ মিটিয়ে পুতুল খেলেছি। মাটির পুতুল, চীনে মাটির পুতুল, কাচের পুতুল, রাসমেলা থেকে কেনা কড়ি পুতুল এদের নিয়েই ছিল সংসার। আয়োজন বেশি না হলেও আনন্দ ছিল বেশি। মা রং-বেরঙের পুঁতির মালা গেঁথে দিতেন পুতুলের। দিদা গদি-তোশক বানিয়ে দিতেন। মা-মাসিদের কোনো শাড়ি ভালো লাগলেই বায়না ধরতাম তা কেটে পুতুলের শাড়ি বানানোর জন্য।
সেই ছোট বয়স থেকে গল্পের বই পড়ার অভ্যেস ছিল। প্রথমে বড়দের মুখে গল্প শুনতাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাছের লাইব্রেরি থেকে অবনীন্দ্রনাথ, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার প্রমুখ লেখকদের বই এনে পড়তে লাগলাম। ‘শিশু ভারতী’ বলে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের ১২ খন্ডের একটি সংকলন ছিল, যা থেকে জানা যেত বিজ্ঞান, ভূগোল, সাহিত্য, দেশ-বিদেশের কথা। গোগ্রাসে গিলতাম ওই বইগুলো। নৃপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ পড়ে ইংরেজি সাহিত্যের ওপর অদ্ভুত একটা টান জন্মায়। আর তা থেকেই ভবিষ্যতে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।
ছোটবেলায় নিজের হাতে লেখা একটা পত্রিকা বের করতাম ‘খেয়া’ নামে। তখন ওটাই ছিল সব ভাইবোনের সাহিত্যচর্চার মাধ্যম। বয়স আন্দাজে বেশ পাকা পাকা গল্প লিখতাম। গ্রীষ্মের দুপুরে দিদি জানালা বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে গল্প বলতেন। মন তখন কল্পনার ডানায় ভর করে ঘুরে বেড়াত দূর দেশে। ভাবনা-চিন্তার লাগাম ছাড়া সুযোগ ছিল তখন।
বাড়িতে প্রায় সবাই অধ্যাপক ছিলেন। আমি ভাবতাম অধ্যাপক হব না, লেখক হব। লেখার সঙ্গে জড়িত কোনো পেশায় যাব, সাংবাদিক হব। গেলাম অশোক সরকারের বাড়িতে। মেয়েদের তখন চাকরিতে নেওয়ার তেমন চল ছিল না। অবশেষে পরিবারের আর সবার মতো অধ্যাপনাই শুরু করলাম। বিয়ে হলো, সংসার শুরু হলো।
আয়োজন করে লেখার অবসর তখন ছিল না। যখন-যেমন মনে আসত লিখতাম। সে সময় অরবিন্দের সনেটগুচ্ছ অনুবাদ করে নলিনীকান্ত গুপ্তর অনেক প্রশংসা পেয়েছিলাম। সেখান থেকেই একটা প্রকাশের জায়গা তৈরি হলো। পরবর্তীকালে সমারসেট মম, ডিএইচ লরেন্সের অনুবাদ করি; যা রূপা থেকে প্রকাশিত হয়।
এভাবেই চলছিল জীবন সংসার, ছেলেমেয়ে, ছাত্রছাত্রী পড়ানো, খাতা দেখা প্রভৃতি। ছেলেমেয়েকে যেসব গল্প শোনাতাম, সে গল্পই লিখতে শুরু করলাম। প্রকাশিত হলো আনন্দমেলায়। ১৯৮১ সালে দেশে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বেহুলার ভেলা’। সেটা পড়ে সকলের ধারণা হয়, এ কোনো মহিলার লেখা নয়। এরপর উপন্যাস লেখার বরাত এলো। তখন আর সব সামলে অত সময় কোথায়। ছোটগল্প লেখাই বরং অনেক সহজ ছিল। তবে লেখাটা চিরকালই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে আমার মধ্যে। জোর করতে হয়নি। কখনো আগাম পরিকল্পনা নিয়েও লেখিনি। আমার মনে হয়, লেখকসত্তাটা জন্মগত। লেখকদের একটা আলাদা দেখার চোখ থাকে। শব্দ বন্ধ, বাক্যবিন্যাস নিয়ে থাকে স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ। একটা লেখা শুরু করার সময় কিন্তু কখনই ভাবিনা তার শেষটা ঠিক কোনো ছাচে হবে। নিজের খেয়ালেই চলতে থাকে গল্পের ধারা, তার চরিত্র ভালো। একটা লেখা শেষ করে অনেক দিন বিশ্রাম নেই। চুপচাপ বসে কাটাই।
এখন এই ফ্ল্যাট বাড়িতে ছাদের খুব অভাববোধ করি। আগে যখন অবসর সময়ে ছাদে ঘোরাঘুরি করতাম, মাথায় আসত নতুন চিন্তাভাবনা। এখন এই ভাগের ছাদে সে সুযোগ আর নেই। অবসর নেওয়ার পর প্রতিবছর নতুন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলাপের সুযোগ আর ঘটে না, যা এককালে লেখার রসদ যোগাত। বন্ধুবান্ধব অনেক আছে, যাদের সঙ্গে গল্প, আড্ডা আজও উদ্দীপকের কাজ করে।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, আমি নারীবাদী কি না বা এই নারীবাদ দ্বারা কতটা প্রভাবিত। বলে রাখি, আমি কিন্তু কোনো ইজমে বিশ্বাসী নই। আমি নিজে একজন নারী, তাই সমাজে তাদের অবস্থান, দুঃখ-যন্ত্রণাটা চোখে পড়ে বেশি। পুরুষরাও মেয়েদের কথাই লেখে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে স্থান দেয় না। সামাজিক পরিসরেও নিষ্পেষিত তারা। ৪৯৮-এ ধারা থাকলেও তার সুযোগ নেয় একদল মতলবী মহিলা। যাদের সত্যিই প্রয়োজন, তারা লজ্জা কাটিয়ে উঠে আসতে পারে না আদৌ। একটা কথা বিশ্বাস করি, ইজমে বদ্ধ হলে স্বাধীনতা নষ্ট হয়। লেখকের সৃষ্টি ক্ষমতা আর থাকে না।
বিশ্বায়নের এ যুগ কিন্তু বাজারসর্বস্ব। বড় পাবলিশিং হাউসগুলো মনে করে, পাঠক যেমন চায়, লেখককেও তেমনই লিখতে হয়। বাজারের চাহিদা গ্রাস করেছে লেখককেও। গলা টিপে ধরা হয়েছে সাহিত্যের। এসএমএস, নেট, চ্যাটিং, ডেটিং হাল ফ্যাশনের এই আধুনিকতাকে বিষয় করেই তাই এগোতে হচ্ছে সাহিত্যকেও। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, গভীরতা, দর্শন-এসবের স্থান কমে যাচ্ছে। এভাবে সাহিত্য হয় না। আমাদের সংস্কৃতি, ধর্মাচরণের যে বৈচিত্র্য, তাই হারিয়ে যাচ্ছে। টহরভড়ৎসরঃু রং ধ করষষবৎ এমতাবস্থায় ডিকেন্স হার্ডিকেও নির্দিষ্ট বিষয় বলে দিয়ে সাহিত্য রচনা করতে দিলে, তারা তা কতদূর পারতেন সন্দেহ আছে। এ ক্ষয়িষ্ণু সমাজের দায় কিছুটা সাহিত্যকেও নিতে হচ্ছে। আর তাই আজ তার গতি রুদ্ধ। যাপনের একঘেয়েমি গ্রাস করেছে সাহিত্যকে।
"