মাহফুজ আল মাদানী

  ১৮ আগস্ট, ২০১৭

ঐতিহ্যের টানে বগুড়ায়

২২ জুলাই ছিল আমাদের পূর্বনির্ধারিত বগুড়ায় শিক্ষা সফর ও আনন্দ ভ্রমণ। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও যারা মদিনা হতে শিক্ষা সমাপন করে দেশে অবস্থান করছেন তাদের সমন্বয়ে এ সফর প্রাণের মিলনমেলায় একাকার হয়ে আছে। স্মৃতিতে অমলিন থাকবে আজীবন।

দেশের বিভিন্ন স্থান হতে আমরা জড়ো হই বগুড়ায়। সকালে বিশ্রাম শেষে নাশতা শেষ করে বের হই বগুড়ার প্রসিদ্ধ স্থানসমূহ দেখতে। আমাদের কাফেলায় ছিলেন শায়খ মোস্তফা সাইফুদ্দীন আল মাদানী, শায়খ মুহাম্মদুল্লাহ আল মাদানী, শায়খ মাহফুজ আল মাদানী, মাসউদ আবদুস সালাম, মিসেস মাসউদ আবদুস সালাম, মাসুম বিল্লাহ ফিরোজী, মিসেস ফিরোজী, আশিকুর রহমান, মিসেস আশিকুর রহমান, রমজান আলী, মিসেস রমজান আলী, ফাহাদ মৃধা, হাবীবুল্লাহ, আশিকুর রহমান, মিসেস আশিকুর রহমান প্রমুখ। তাদের অনেকেই মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সমাপন করেছেন। আর বাকিরা বর্তমানে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়নরত। রাহবার হিসেবে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন ওই প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আলহাজ আবদুল জলিল।

প্রথমেই আমরা ভ্রমণ শুরু করি বগুড়ার প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিল মাদরাসা প্রদর্শনের মাধ্যমে। এ মাদরাসা বগুড়া শহরে অবস্থিত। যে প্রতিষ্ঠানটিতে সাড়ে তিন হাজারের মতো শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। কথা হলো মাদরাসার দায়িত্বরত একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাদের আতিথেয়তা আমাদেরকে মুগ্ধ করে তুলেছিল।

জামিল মাদরাসা থেকে আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বেহুলা লক্ষীনধরের বাসরঘর দেখতে ছুটে চলি। বেহুলার বাসরঘর বগুড়া সদরের গোকুল নামক স্থানে অবস্থিত। বগুড়া শহর হতে প্রায় ১১ কিলোমিটার উত্তরে এর অবস্থান। এটি একটি বৌদ্ধস্তম্ভ; যা স¤্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। স্তম্ভের পূর্বার্ধ্বে রয়েছে ২৪ কোণবিশিষ্ট চৌবাচ্চা সদৃশ একটি গোসলখানা। এটি বেহুলার বাসরঘর নামেই বেশি পরিচিত। বেহুলাকে নিয়ে লোখমুখে অনেক কিসসা-কাহিনি রয়েছে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা সেই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান দেখে মন জুড়াবে যে কারোরই।

বেহুলার বাসরঘর প্রদর্শন শেষে রওনা হই মহাস্থানগড়ে। মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে পু-্রবর্ধন বা পু-্রনগর নামেও পরিচিত ছিল। একসময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও আগে অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেই তার প্রমাণ মিলেছে। ২০১৬ সালে এটি সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা হয়।

মহাস্থানগড়েই রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। আমাদের কাফেলা চলল এবার জাদুঘরের দিকে। মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরটি ১৯৬৭ সালে করতোয়া নদীর কিনারা ও মহাস্থানগড়ের টিলাসংলগ্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। মহাস্থানগড়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে উদ্যোগ নেওয়া হয় প্রত্নতাত্ত্বিক এই জাদুঘরের। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এটি দেখাশোনা করছে। উত্তর অঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থানগুলো মহাস্থানগড়, দিনাজপুর, পাহাড়পুর, শেরপুর, রানী ভবানীপুর এলাকা থেকে বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করা প্রাচীন সামগ্রীগুলো জাদুঘরে শোভাবর্ধন করে আছে। হাজার হাজার বছর আগের সোনা, রুপা, লোহা, ব্রোঞ্জ, পাথর, কাঁসাসহ বিভিন্ন মূল্যবান ধাতব পদার্থ ও পোড়ামাটির তৈরি মূর্তি, আত্মরক্ষার জন্য ধারালো অস্ত্র, নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র ইত্যাদি সামগ্রী সাজিয়ে রাখা হয়েছে মহাস্থানগড় জাদুঘরে।

মহাস্থানগড় জাদুঘরের ঠিক সামনেই গোবিন্দ ভিটা অবস্থিত। এবার আমরা ছুটে চলি গোবিন্দ ভিটা দেখতে। এ ভিটা একটি খননকৃত প্রত্নস্থল, ১৯২৮-২৯ সালে এটি খনন করে। গোবিন্দ ভিটায় দুর্গ প্রাসাদ এলাকার বাইরে উত্তর দিকে এর অবস্থান। এ প্রত্নস্থলটি স্থানীয়ভাবে গোবিন্দ ভিটা নামে পরিচিত।

মহাস্থানগড়ের দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে পরশুরামের প্রাসাদ উল্লেখযোগ্য। স্থানীয়ভাবে এটি হিন্দু নৃপতি পশুরামের প্যালেস নামে পরিচিত। পরশুরামের প্রাসাদ ঘিরে রয়েছে মহাস্থানগড়ের সীমানাপ্রাচীর। এই প্রাচীর এত চওড়া ছিল যে, যার ওপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে টহল দেওয়া হতো। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ স্বচক্ষে প্রদর্শন না করলে এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলদ্ধি করা সম্ভব নয়।

পরশুরামের প্রাসাদ প্রাচীর দেখে ছুটে চললাম জিউৎকুন্ড কূপের দিকে। জিউৎকুন্ড কূপটি শীলাদেবীর ঘাটের পশ্চিমে অবস্থিত। এটি একটি বড় কূপ। যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্ন তাত্ত্বিক নিদর্শন। কথিত আছে, এই কূপের পানি পান করে পরশুরামের আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে যেত। তবে এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। কূপটি এখন পানিশূন্য।

জিউৎকুন্ড কূপ প্রদর্শন করে ইসলাম প্রচারে বগুড়া জেলায় যার অবদান অনস্বীকাযর্, সেই মহামনীষী হজরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী রহ.-এর মাজার দেখতে রওনা হলাম। মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা পশ্চিমে এ মাজার শরিফ অবস্থিত। শাহ সুলতান বলখী রহ. ১৪০০ শতাব্দীর একজন ইসলাম প্রচারক ছিলেন। তিনি বল্লখ রাজ্যের রাজার পুত্র ছিলেন বিধায় তাকে শাহ সুলতান বলখী বলা হয়। শাহ সুলতান বলখী রহ.-এর মাজার দেখে আমরা মোলামগাড়ী মাদরাসাসহ বগুড়ার প্রসিদ্ধ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখি। ঘোরাঘুরির একপর্যায়ে বগুড়ার প্রসিদ্ধ কটকটি আর দই ক্রয় করি নিজেদের গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সবশেষে মিলিত হই শায়খ মোস্তফা সাইফুদ্দীন আল মাদানী ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত স্কুল অব দি হলি কুরআন-এ। সেখানে হলরুমে আমাদের পূর্বনির্ধারিত ঈদ পুনর্মিলনী ও ক্রেস্ট প্রদান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের সফরের সমাপ্তি ঘটে। বগুড়ায় মোস্তফা সাইফুদ্দীন আল মাদানীসহ অন্য গণ্যমান্য লোকজনের আতিথেয়তা আমাদেরকে মুগ্ধ করে। স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী মহাস্থানগড়ের এ সফর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist