সোহেল নওরোজ

  ১১ আগস্ট, ২০১৭

রূপকথা নয় আশ্চর্যকথা

রূপকথার গল্পে অতিরঞ্জিত অনেক বিষয় থাকে। কল্পকথায় বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচল সৃষ্টি হয়। সম্ভাব্য পরিণতি আঁচ করা যায়। যেখানে রাজকুমারের অবধারিত বিজয় লেখা থাকে। সে অর্থে এটি রূপকথার সব শর্ত পূরণ করবে না। তবে পরতে পরতে আপনাকে শিহরিত করবে। জীবনের বাঁকে বাঁকে সংগ্রাম আর সাফল্যের যুগপৎ অবস্থান বিস্মিত হবে। তবে এর কোনোটিই অতিমানবীয় নয়। মানুষের পাশে থেকেই লিখেছেন একটি দেশের জন্মকথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাই ঠিক রূপকথার নায়ক নন; জনমানুষের নায়ক, নেতা। একটি দেশের প্রতিষ্ঠাতা। তার কাহিনি রূপকথা নয়, আশ্চর্যকথা! যেখানে নায়কের প্রয়াণ ঘটলেও তিনি বেঁচে থাকেন দেশের হৃৎপি- হয়ে। দেশের অস্তিত্ব তার কীর্তিকে বয়ে বেড়াবে অনন্তকাল। যার সমাপ্তি ঘটবে না কখনো। এটি যে এক অসমাপ্ত আশ্চর্যকথা!

‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’-বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র শুরুতেই তার জীবন, মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা ও মহৎ রাজনৈতিক দর্শনকে প্রতিভাত করে কথাগুলো। আমরা দেখতে পাই, ঘোর অন্ধকার আর অনিশ্চয়তার মধ্যে আলো হাতে চলা এক মহান নেতাকে। যিনি বঞ্চিত-নিপীড়িত একটি জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। জীবনের সব সুখ উপেক্ষা করে, অমানবিক অত্যাচার সয়ে এই ধরণির মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের অবস্থান করে দিয়েছিলেন। তার পরও জনগণের বন্ধু হিসেবে থেকেছেন শেষ দিন পর্যন্ত।

আমরা জন্মেছি সৌভাগ্যের পরশমণি সঙ্গে করে, আঁতুড়ঘর হতেই স্বাধীনতার তিলক মেখে। স্বাধীনতা-পরবর্তী এ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকা কেবল মুখে শোনা বা বই-পুস্তকে পড়া কাহিনি। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার গল্পের বিশেষ একটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে উপস্থাপন করেছেন বিষাদের স্মৃতি বুকে নিয়ে, অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে। ‘আজকালকার ছেলেমেয়ের কাছে আমাদের চোখের এই অশ্রুর কারণ আমরা কোনো দিনও স্পষ্ট করতে পারব না। ’৭১-এর স্মৃতির যে বেদনা আমরা হৃদয়ে লালন করি; এরা তার গভীরতা কোনো দিনই বুঝবে না। বোঝার প্রয়োজনও তেমন নেই। এরা সুখে থাকুক। কোনো দিনও যেন আমাদের মতো দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে তাদের যেতে না হয়।’ ইতিহাসের মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু স্বতন্ত্র পথ তৈরি করে এগিয়ে গেছেন। পরাধীনতার শেকড় গুঁড়িয়ে এ দেশটিকে নিয়ে গেছেন স্বাধীনতার বন্দরে।

বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ যেন সমার্থক দুটি শব্দ! অভিন্ন সত্তা। তার নামেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। তার আহ্বানেই জীবনবাজি রেখে নয় মাস যুদ্ধ করেছেন স্বাধীনতাকামী অকুতোভয় বাঙালিরা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমরা মুক্তিসংগ্রাম তথা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি। দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা ২৭ বছর কারাবাসে ছিলেন। তুরস্কের জন্য আতাতুর্কের অবদান অসামান্য। ভিয়েতনামের কথা ভাবলেই হো চি মিনের প্রসঙ্গ এসে যায়। ইতিহাস ঘাঁটলে এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়। এটিই ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারা। প্রতিটি জাতির মুক্তিসংগ্রামে একজনই নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আপসহীন রাজনৈতিক কর্মকা-, নিরঙ্কুশ জনসমর্থন এবং জাতির ক্রান্তিকালে ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হয়েছিলেন এ জাতির অবিসংবাদিত নেতায়।

বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল এ দেশের মানুষকে সর্বপ্রকার পরাধীনতা থেকে বের করে আনা। আত্মসচেতনতার বীজ বুনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বোধ ও শক্তি জাগ্রত করা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাই অনিবার্য ছিল। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির স্বপ্নপূরণ সম্ভব হবে না। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি তথা স্বাধীন ভূখ- প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলের ১৩ বছরই কারাগারে ছিলেন। বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুকে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। এমনকি পাকিস্তানে বন্দি থাকাকালেও তার নামে এবং নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কেবল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা অর্জিত হয়নি। এজন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। একটি মানুষের আহ্বানে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এ দেশের অসংখ্য মানুষ লড়াই করেছিলেন। সব শ্রেণি-পেশার লোক এক কাতারে দাঁড়িয়েছিলেন। চূড়ান্ত সাহসিকতায় নিজেদের জীবনের বিনিময়ে কিনেছিল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও এমন আত্মদান বিরল।

বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন-বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী। এর প্রায় সবগুলো আন্দোলনেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন নেতৃত্বস্থানে। বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে ২৩ বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ। যার চূড়ান্ত সিগন্যাল ছিল ৭ মার্চ ১৯৭১, রেসকোর্স ময়দান। সেখানেও নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এসব ক্ষেত্রে বাঙালির স্বার্থ চিন্তাই তাকে সাহসী ও অনমনীয় করে তুলেছিল। তিনি নিজেকে ‘রাজনৈতিক কর্মী’ বলে আখ্যা দিতে পছন্দ করতেন। মূলত মানুষের পাশে থেকে তাদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াস ছিল জীবনভর। মানুষের কাতারে থেকেও ধাপে ধাপে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহানায়ক। কালক্রমে মুক্তিসংগ্রামের এক মহৎ অধ্যায় পেরিয়ে বাঙালি জাতির জন্য এনে দেন স্বপ্নের স্বাধীনতা।

শেখ মুজিবুর রহমান নামের অসীম সাহসী, খাঁটি দেশপ্রেমিক, কর্তব্য সচেতন এবং জনদরদি এক ভূমিপত্রের জন্ম হয়েছিল এই বঙ্গদেশে। বাল্যকাল ও কৈশোর থেকে বিভিন্ন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়া বঙ্গবন্ধু আজীবন একটিই সাধনা করেছেন-বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। নিজে পরিশ্রমী কর্মী ছিলেন। কর্মী থেকে হয়েছিলেন বিচক্ষণ সংগঠক। সংগঠক থেকে অতুলনীয় নেতা। নেতা থেকে একটি জাতির জনক। এভাবেই ইতিহাসে নির্ধারিত হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান। শেখ মুজিবের উচ্চতায় কেবল তাকেই মানায়, অন্য কাউকে নয়। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কবি রফিক আজাদের একটি উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য, ‘এ দেশের যা-কিছু তা হোক না নগণ্য, ক্ষুদ্র তার চোখে মূল্যবান ছিল-নিজের জীবনই শুধু তার কাছে খুব তুচ্ছ ছিল; স্বদেশের মানচিত্রজুড়ে পড়ে আছে বিশাল শরীর....।’ (এই সিঁড়ি)।

আজ বিশ্বব্যাপী যেখানেই মুক্তির সংগ্রাম, সেখানেই অনুপ্রেরণা বঙ্গবন্ধু। আক্ষরিক অর্থেই তিনি গড়েছিলেন আদর্শের সিঁড়ি। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মর্মকথাই ছিল, দেশকে ভালোবাসা, মানুষের দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ানো আর নিবেদিত সততা নিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম ও জঘন্য হত্যাকা-ের মাধ্যমে তার নাম মুছে ফেলার যে অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল, তা ব্যর্থতাতেই পর্যবসিত হয়েছে। কোটি কোটি বাঙালির মনে তিনি চিরভাস্বর, বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ। বাংলাদেশ ছিল তার স্বপ্নভূমি, ইচ্ছা পূরণের দেশ। বঙ্গবন্ধু তার সব ইচ্ছা পূরণ করে যেতে পারেননি। এখানেই রূপকথার সঙ্গে যা একটু অমিল। তিনি তাই রূপকথার নয়, আশ্চর্যকথার নায়ক। যে নায়ক অন্তর্ধানের পর আবার নতুন করে জেগে ওঠেন। তার স্বপ্নগুলোকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেন। অসমাপ্ত কাজগুলোকে তুলে দেন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। যে আশ্চর্যকথায় আমরা মোহিত হই, শিহরিত হই, প্রেরণা বোধকরি; তার দাবি উপক্ষো করা যায় না কোনোভাবেই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist