মো. ওসমান গনি

  ২৮ জুলাই, ২০১৭

গল্প

একটি লাল গোলাপের খোঁজে...

‘যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে, ফুল তো থাকে ফুটিতে/বাতাস তারে উড়িয়ে নিয়ে যায়, মাটি মেশায় মাটিতে।/গন্ধ দিলে, হাসি দিলে, ফুরিয়ে গেল খেলা/ভালোবাসা দিয়ে গেল, তাই কি হেলাফেলা’। এই গান শুনতে শুনতে কেন জানি না বারবার মনে পড়েছে কবি রাইনে মারিয়া রিলকের কথা। রিলকে মারা যান গোলাপ কাঁটা ফুটে। কবি কি জানতেন! হয়তোবা। ‘যে গোলাপ তার মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে তার মৃত্যুকেও করে দেবে গোলাপের মতন রক্তিম।’ কবি বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়, এলিজ ও সনেট গুচ্ছের সমাপ্তির পরের বছর থেকেই রিলকের স্বাস্থ্যে ভাঙন ধরল, মাঝে মাঝে আরোগ্যশালায় যেতে হয়। তারপর এক দিন একটি গোলাপ ফুল তুলতে গিয়ে আঙুলে কাঁটা ফুটল, সেই ছোট ক্ষতের ছিদ্রপথে তাকে আক্রমণ করল লিউকিমিয়ার মতো এক যন্ত্রণাময় রোগ, যাতে রক্তের শ্বেতকণিকা মারাত্মকভাব বৃদ্ধি পেতে পারে। সে ‘ব্যক্তিগত’ মৃত্যুকে রিলকে মহিমান্বিত করেছিলেন নিজের রচনায়, তার ভাগ্যে তা মঞ্জুর হলো না তারই ইষ্টিপত্র অনুসারে তাকে কবর দেওয়া হলো নিকটবর্তী একটি গির্জার প্রাঙ্গণে। সমাধিস্তম্ভে উৎকীর্ণ হলো সেই ক্ষুদ্রাকার, কিন্তু বহু স্মৃতিসহ কবিতা, যা তিনি মৃত্যুর এক বছর আগে লিখে রেখেছিলেন ‘গোলাপ বিশুদ্ধ স্ববিরোধ, কারোরই নিদ্রা/না-হবার আনন্দ তুমি, অনেক চক্ষু পল্লবের তুলে’।

একটি লাল গোলাপের খোঁজে...

‘কবিতায়, গানে অজ¯্র গোলাপ ফুটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, সে আমাদের জন্যে। ছবিতেও এঁকেছেন একটা দুটো, সেও আমাদের দেখা।’ কিন্তু পারস্য প্রেমোপাখ্যানের সেই রাজপুত্র, পাখি ও গোলাপকে আমরা কখনো ভুলতে পারি না। অবশেষে রাজপুত্র তার প্রেমিকার জন্য একটি লাল গোলাপের খোঁজে বেরিয়েছিলেন। তার চাই গোলাপ, লাল গোলাপ। কোথাও পেলেন না। পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামল। রাজপুত্র গোলাপ গাছের নিচে বসেই কাঁদতে লাগলেন। যেন ‘প্রাতে পড়েছে শিশির কণা, সাঁঝে বহিছে দখিনা বায়/কাছে ফুলবালা সারি সারি, দূরে পাতার আড়ালে সাঁঝের তারা, মুখখানি দেখিতে চায়।’

এক অচেনা পাখি রাজপুত্রের দুঃখে কাতর হয়ে রাজপুত্রকে বলল, সারা রাত ধরে আপনি এই গাছের নিচে বসে কাঁদতে থাকবেন। আর আমি নিজের বুকে গোলাপ কাঁটা বিঁধিয়ে রক্ত ঝরাব, এই রক্তভেজা প্রার্থনায় আগামী প্রত্যুষে জন্ম হবে পৃথিবীর প্রথম রক্ত গোলাপ। ভোরের আকাশ ফরসা হয়ে ওঠে। অন্য পাখিরা গাইতে শুরু করেছে। শুধু একটি পাখি গান গাইল না। রাজপুত্র দেখলেন, অসংখ্য ফুলের মাঝে একটি লাল গোলাপ। গোলাপের দিকে হাত বাড়ালেন রাজপুত্র। আর সেই অচেনা পাখিটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। মৃত্যু এমনই ভয়ংকর সুন্দর, কবি রিলকে হয়তো জানতেন, জানতেন এই অচেনা পাখির মতো রবীন্দ্রনাথও। “গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, ‘সুন্দর’, সুন্দর হলো সে।”

ফুল ফুটে ঝরে যায়...

ফুলের সঙ্গে প্রেম ও ভালোবাসার সম্পর্ক সুনিবিড়। ফুল কখনো প্রিয়ার কালো কুন্তলে, সুদৃশ্য কবরীতে, কখনো রুমালের কোণে, বালিশের কভারে, কখনো সাদা বা রঙিন কাপড়ে বোনা আলপনায়। আয়নায় বাঁধানো প্রবাদ বাক্য। ‘ফুল ফুটে ঝরে যায়, রেখে যায় বৃতি, মানুষ মরে যায়, রেখে যায় স্মৃতি।’

শেক্সপিয়ার লেখেন, ‘যে ফুল আর গান ভালোবাসে না, সে মানুষ খুন করতে পারে।’ কবি যাই বলুন, মানুষ ফুল ভালোবাসে। পৌরাণিক কাহিনির দেবদূতরা পৃথিবীর যুদ্ধ বিজেতাদের উদ্দেশে পুষ্প বৃষ্টি করতেন। সেই পৌরাণিক যুগ থেকে শুরু করে ফুল আজও শান্তি, সুন্দর, প্রেম ও নারীর সঙ্গে তুলনীয়। ফুলের এই সৌন্দর্য অনুভব করা যায় অবসরে, নির্জন একাকিত্বে, বড়জোর দুজনে দুজনায়। ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুল ডোরে বাঁধা ঝুল না।’

প্রেয়সীর হাতে লাল গোলাপ... ফুলের সঙ্গে শুধু সম্পর্ক মানব-মানবীর নয়। শ্যামল বাংলায় ঋতুচক্রের পালাবদলের সঙ্গেও। যেমন শীতে গোলাপ, বর্ষায় বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল কিংবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি অপু-দুর্গার কল্যাণী মায়ের করুণ কথা পাঠকদের নিশ্চয় মনে পড়ে, সেই যে ফুলের নামে নাম যার, সর্বজয়া। এই ফুলের অন্য নাম কলাবতী। এর বাইরেও এক রকমের অলৌকিক, আধ্যাত্মিক ও অতিন্দ্রিয় সম্পর্ক রয়েছে ফুলের সঙ্গে মানবের। যাকে আমরা বলি, ভালোবাসার অধিক পাওয়া। ফুল তখন হয়ে উঠে প্রকৃতির বাহন। তন্ময় হয়ে প্রকৃতিকে দেখা। শ্রাবণের ধারার মতো ঝরে পড়ে চোখের জল, মৃদু বিষণ আলোর অদৃশ্য এক স্বপ্নতাড়িত পৃথিবী পত্রপুষ্পে ভরে ওঠে, যা শুধু অনুভবে ছোঁয়া যায় না। এক অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে দেয় হৃদয় মনে। সেই ফুল ফোটে আর ঝরে যায় মনের গহিনে বিজনে। সে সুখ আলাদা। অতিন্দ্রিয়।

ফুলের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে তার এক নিবিড় সুখ সম্পর্ক গড়ে উঠে সেই আদিকাল থেকে। শীত গত হয়ে যায়, বিদায় নেয় বৃষ্টি। এবং পুষ্প প্রষ্ফুটিত হলে ভূমলে ভালোবাসার পাত্র-পাত্রীর হৃদয়ে আবেগের বন্যা বয়ে যায়। পাখিরা পদচারণা করতে থাকে কলকাকলীমুখর পৃথিবীতে। বাইবেলে ওল্ড টেস্টামেন্টের সলোমনের গানের একটি অংশ থেকে উদ্ধৃত করা হলো উপরের এ বাক্য। ফুলের সঙ্গে মানুষের আদিম সৌন্দর্য পিপাসু মনের মিলনের সংবাদ আমরা পেয়েছিলাম এক দিন সলোমনের গানে; আর আজী, এত বছর পরেও ফুলের সেই প্রাগৈতিহাসিক সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা নিয়ে মানুষ ভাবে। কল্পনা করে। কবি কাব্য করে। প্রেমিক তুলে দেয় তার প্রেয়সীর হাতে লাল গোলাপ। সুন্দর ও সুরুচির কাছে কবির আত্মসমর্পণ।

বাবরের হাত ধরে গোলাপ এলো ভারতবর্ষে... স্পেনীয় হিমেনেথের ভাষায় : ‘গোলাপকান্তি তোমার রচিত নগ্নতায়।’ হয়তো বাবর গোলাপের নগ্নতায় মুগ্ধ হয়ে গোলাপেরই প্রেমে পড়েছিলেন। অনেকের ধারণা, ভারতবর্ষের মাটিতে যে মোগল রাজপুত্রটি প্রথম চারা পুঁতেছিলেন গোলাপের, তার নাম সম্ভবত বাবর। কেন পুঁততে বাধ্য হয়েছিলেন তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, পারস্যের চিঠিতে এ পর্যন্ত সয পারস্যে দেখে আসছি এরা বাগানকে কী ভালোই না বাসে। এখানে চারদিকে সবুজ রঙের দুর্ভিক্ষ। তাই চোখের ক্ষুধা মেটানোর এই আয়োজন। বাবর ভারতবর্ষে বাগানের অভাব দেখে অবজ্ঞা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এসেছিলেন মরু প্রদেশ থেকে, বাগান তাদের পক্ষে শুধু কেবল বিলাসের জিনিস ছিল না। ছিল অত্যাবশ্যক। তাকে বহু সাধনায় পেতে হয়েছে বলে এত ভালোবাসা।

ভারতবর্ষে যা যা না পেয়ে বাবর বিরক্ত, সে দীর্ঘ তালিকায় প্রধানত দুটো হলো সামঞ্জস্য আর বাগান। আগ্রায় পৌঁছেই তাই বাগানে হাত, ঠিক যেমন গড়েছিলেন কাবুলে। অর্থাৎ পারস্যিক ঘরানার জ্যামিতিক ছাদে। ভারতবর্ষের মাটিতে তার প্রথম স্বরচিত বাগানে ফুল ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্মৃতি কথায় লিখলেন, ‘শেষ পর্যন্ত সুষমা ও সামঞ্জস্যহীন এই হিন্দুস্তানে বাগান বানানো গেল একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা সহকারে চারদিকে মানানসই প্রান্তরেখা এবং নকশা দিয়ে প্রতিটি প্রান্তকে গোলাপ আর নার্সিসাসের নিখুঁত বিন্যাসে সাজিয়ে।

বাবরের এই বাগান আগ্রা থেকে ক্রমেই তার শিকড় ছড়াল ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে। ভিন দেশের গোলাপ ভারতবর্ষের জল-হাওয়াকে আপন করে নিল অচিরাৎ ফুটন্ত ডালপালায়। মোগল-মিনিয়েচারে গোলাপ উঠে এলো রাজপুত্র-রাজকন্যাদের হাতে। কিন্তু কবিতায় তখনো শুরু হয়নি গোলাপের ফুটে ওঠা। যদি উঁকিঝুঁকি দিয়েও থাকে কোথাও, সে শুধু ফারসি কবিতাতেই হয়তো। হয়তো ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদের মারফত পরিচয়ের আগে গোলাপকে স্বতন্ত্র মর্যাদার ফুল হিসেবে অভ্যর্থনা জানানোর আগ্রহ ঢেউ তোলেনি এ দেশের কবিদের উপলব্ধির ভেতরে।

কবিতায় গোলাপ

ওমর খৈয়াম-

দীর্ণ হিয়া কোন সে রাজার/রক্তে নাওয়া এই গোলাপ/কার দেওয়া সে লালচে আভা/হৃদয়-ছেঁচা শোণিত ছাপ

শেক্স্পিয়ার-

প্রাণভরে চাইবার এ বিশ্বব্রহ্মান্ডে/কিছু নেই,/গোলাপ আমার থাকো/সবর্স্ব রয়েছে তোমাতেই।

পাবলো নেরুদা-

ও মেয়ে, গোলাপ বনের মেয়ে/উষ্ণ কোমল পারাবাতের বুক/বুকে বন্দী মাছ, গোলাপলতা

লবণাক্ত তৃষ্ণাভরা গেলাস /তোমার হৃদয়/পুঞ্জ পুঞ্জ আঙুরে টসটসে/তোমার ত্বক।

মাচাদো আন্তনিও-

আমার গোলাপেরা কি এখনো ঘ্রাণ/মেখে দেয়/তোমার হীরের মতো উজ্জ্বল/স্বপ্নের ভুরুতে?

নাজিম হিকমত-

আমার ডান হাতে আস্তে আস্তে/পাপড়ি খুলছে এক বিষণ গোলাপ

বাবর-

লালে লাল গোলাপের কুঁড়ির মতো/আমার হৃদয়/আগুনের ভাঁজে ভাঁজে মোড়া।/হাজারো বসন্তের হাওয়া কি পারবে/কোন দিন/হৃদয়ের সে কুঁড়িকে/ফুটিয়ে দিতে গোলাপে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-

লক্ষ কোটি গ্রহতারা আকাশে/বহন করিয়া চলে প্রকান্ড সুষমা/ছন্দ নাহি ভাঙে তার সুর নাহি বাধে,

বিকৃতি না ঘটায় স্খলন;/ঐ তো আকাশে দেখি স্তরে স্তরে/পাপড়ি মেলিয়া/জ্যোতির্ময় বিরাট গোলাপ।

কাজী নজরুল ইসলাম-

তোমার যে প্রিয়া/গেল বিদায় নিয়া/অভিমানে রাতে গোলাপ হয়ে/কাঁদে তাহারি কামনা/উদাস প্রাতে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়-

আমারও প্রিয় রং লাল/আমারও প্রিয় ফুল গোলাপ। আমি লড়ছি

লাল গোলাপের জন্যে।

পুনশ্চ : গোলাপ ও কমলকুমার মজুমদার-

‘গোলাপ সুন্দরী’ উপন্যাসে কমলকুমার মজুমদার যেন আমাদের শিখিয়ে গেলেন ভাষায় গোলাপকে যে কতখানি সম্মানিত, কতখানি রহস্যময় অস্তিত্বের একটি জটিল কুসুমে জন্মান্তর ঘটানো যায়। ‘গোলাপ সুন্দরী’র নায়কের নাম বিলাস। হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার পর এই বিলাসের একমাত্র বিলাসী স্বপ্ন, গোলাপের বাগান।

হায় গোলাপের মতো বিস্মৃত ফুল আর নাই সমস্ত মুহূর্তে যাহার অনিত্যতা, প্রথমে শুকায় ধীরে, ঝরিয়া চুপ, ক্ষণেকেই কোথায় ফুটিয়া ওঠে, সমক্ষে থাকিয়াও চির-বিস্মৃত’ বিলাস এই রুগ্ণ কথাটি প্রত্যহই বারবার উদ্বিগ্ন প্রষ্ফুটিত গোলাপের প্রতি চাহিয়া ভাবিয়াছে এ সত্য তাহার নিজস্ব অভিজ্ঞতা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist