আহমদ আবদুল্লাহ

  ২৮ জুলাই, ২০১৭

কাশ্মীরের বাঁকে বাঁকে

রেল থেকে নেমে ধীরগতিতে সামনে এগোলাম। চারদিক অন্ধকার। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। ভোর হতে তখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। অস্পষ্টভাবে নজরে পড়ল বড় এক নামলিপি। লেখা ‘স্বাগতম জম্মু-কাশ্মীর’। জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখ-অঞ্চল নিয়ে কাশ্মীর রাজ্য। শীতকালীন রাজধানী জম্মু, গ্রীষ্মকালীন শ্রীনগর। গন্তব্য আমাদের শ্রীনগর। টিকিট কেটে গাড়িতে চেপে বসলাম। ধীরে ধীরে সূয্যিমামা উঁকি দিল পূব দিগন্তে। বরফে ঢাকা পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য চোখে পড়তে লাগল। সবুজে ভরা আশপাশ। অনিন্দ্য পরিবেশ। গাড়ি এগোচ্ছে শ্রীনগরে। শ্রীনগর কাশ্মীরের একটি অন্যতম শহর। শ্রীনগরের জনবসতি লাখ দশেকের বেশি। শহরটি ঝেলুম নদীর তীরে কাশ্মীর উপত্যকায়। চারপাশে রয়েছে হ্র্রদ, বরফে ঢাকা পাহাড়, সুজলা-সুফলা তেপান্তর। ‘উইলো গাছে পূর্ণ অরণ্য পর্যকটদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। এতে তৈরি হয় কার্পেট, রেশম ও পশমের বস্ত্র, কাঠ ও চামড়ার বিভিন্ন জিনিসপত্র।’ কথাগুলো বেশ আগ্রহভরে জানালেন স্থানীয় এক লোক। পরিচয় হলো বেড়াতে এসে। গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ। লক্ষ করলাম চেকপোস্ট। কিছুটা ভড়কে গেলাম যেন। প্রতিটি পয়েন্টে রয়েছে এমন শত চেকপোস্ট। কাশ্মীর ভূস্বর্গ হলেও যুদ্ধকবলিত একটি রাজ্য। একে ঘিরে এ অবধি ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে তিনটে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, ১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালে। এখনো মাঝে মাঝে উভয়পক্ষে হামলা-পাল্টা হামলা চলে। ফলে আতঙ্কে থাকতে হয় পর্যটক কিংবা স্থানীয়দের। এসব কাহিনি শুনতে শুনতে এবং পাহাড়-পর্বত দেখতে দেখতে পা রাখলাম শ্রীনগরে। হাজি বশির চাচা নিয়ে এলেন তার বাসায়। রাত তখন ৮টা। শীতে কম্বল জড়ালাম গায়ে। চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করলেন তিনি। কাশ্মীরের লোকজনের স্বভাবও বেশ গল্প করার মতো। হাজি সাহেবের আপ্যায়নে তেমনটাই বুঝতে পারলাম।

পরদিন ভোরে নাশতা সারলাম তড়িঘড়ি। এরপর ছুটলাম গুলমার্গ। কাশ্মীরের মূল পর্যটনকেন্দ্র যেটি। শীতকালে বরফে ঢাকা থাকে রাস্তাঘাট, গাছপালা, মাঠঘাট। তখন গুলমার্গের সৌন্দর্য বেড়ে যায় দ্বিগুণ। বরফের ওপর স্কিয়িং ছাড়াও গুলমার্গের অন্যতম আকর্ষণ নানা ধরনের ফুল ও সবুজে ঢাকা পরিবেশ। শ্রীনগর থেকে প্রায় ৫৮ কিলোমিটার দূরে জম্মু-কাশ্মীরের বারামূল্লা জেলা। উচ্চতা ২৭৩০ মিটার। দেড় ঘণ্টা বাদে পৌঁছলাম। বরফে ঢাকা চারপাশ। মাখামাখি করে গড়ালাম বহু সময়। বাঁয়ে পড়ল প্রিমিয়াম ক্লিনিক। বেড়াতে আসা কেউ অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এর ঠিক কুড়ি মিটার দূরত্বে গুলমার্গ জামে মসজিদ। ভেতরে নামাজের সুন্দর পরিবেশ। তুষারপাতের দৃশ্য উপভোগ করতে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিজুড়ে এখানে ব্যবহৃত হয় স্কিয়ার। ভারী ঠান্ডা হলেও আনন্দে কমতি রইল না। আশপাশের সবার মাঝেই একপ্রকার উল্লাসের ছাপ দেখতে পেলাম। প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য অন্য কোথাও বিরল। ‘ভূস্বর্গ কাশ্মীর’ এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই গুলমার্গ।

দ্বিতীয় দিন চললাম কাশ্মীরের অন্যতম পর্যটককেন্দ্র নিশাতবাগ। চতুর্দিক নানা ফুলে ভরপুর। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যময় দৃশ্য অবলোকনে মুগ্ধ হচ্ছি বারবার। টিকিট কেটে ভেতরে গেলাম আমরা পাঁচজন। প্রথমেই নজরে পড়ে ঝরনাধারা। হাত দিয়ে ছোঁতেই ভয় পেয়ে গেলাম। ঠান্ডা ভাব পুরো শরীর ছেয়ে গেল। পাশেই ছিলেন বশির চাচা। বললেন, ‘এত তেমন ঠান্ডা না। অথচ দুই মাস আগেও এর দ্বিগুণ ছিল।’ তার কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম, আপনারা থাকেন কিভাবে?

-এভাবেই। অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমরা অন্যত্র এক সপ্তাহও থাকতে পারব না।

-কেন?

- কারণ, গরম সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের কারোর নেই।

- ওহ

হাঁটছিলাম আর কথা বলছিলাম বশির চাচার সঙ্গে। এদিকে দর্শকদের আনাগোনা ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে। কেউ ছবি তোলায় ব্যস্ত আবার কেউ সঙ্গীদের নিয়ে আনন্দে মগ্ন। বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে ঘুরতে আসা পর্যটকদের দেখে মনের ভেতর আনন্দ ভরে ওঠল। তবে বাংলাদেশ থেকে ছিলাম কেবল আমরা পাঁচজন। বলছিলাম নিশাতবাগের কথা। শ্রীনগরের মুঘল বাগানগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর হচ্ছে নিশাতবাগ। মুঘল স¤্রাট শাহজাহানের শ্বশুর এবং স¤্রাজ্ঞী নূরজাহানের বড় ভাই আসিফ খান ১৬৩৩ সালে এই বাগানটি তৈরি করেন। প্রাকৃতিক একটি ঝরনাকে কৃত্রিমভাবে বিভিন্ন ভঙ্গিতে প্রবাহিত করা হয়েছে এবং এই ঝরনাটিতে আছে শত শত কৃত্রিম ফোয়ারা। নীল পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে থাকা এই নিশাতবাগ গড়ে ওঠেছে ৪৬ একর জায়গাজুড়ে। বাগানটিতে মোট ১২টি সোপান আছে অর্থাৎ বাগানটি ধাপে ধাপে ১২ তলা পর্যন্ত ওঠে গেছে। ওপরের ধাপটি মুঘল হেরেমের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এই বাগানটিও পারস্য বাগানের রীতিতে গড়ে উঠেছে, যেখানে ইসলামী স্থাপত্য নকশা প্রাধান্য পেয়েছে। দ্বাদশ সোপান থেকে পাহাড়ের প্রাকৃতিক ঝরনার পানি কৃত্রিম নহরের মাধ্যমে বিভিন্ন ফোয়ারার সাহায্যে নেমে এসেছে এবং সবশেষে এটি ডাল লেকে গিয়ে পড়েছে। এই নহরের পাশে রয়েছে হাজার হাজার ফুলের গাছ এবং চীনার গাছ। ঘণ্টাখানেক ঘুরে বেরিয়ে এলাম নিশাতবাগ থেকে। শেখ সাদি আর মাসুদকে বললাম, চল এবার চলি পরীমহলে। পরীমহলকে ঘিরে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস। বশির চাচাকে বলতেই রাজি হয়ে গেলেন। গাড়িতে চেপে বসলাম সবাই। চালাচ্ছেন চাচা নিজেই। এক ঘণ্টার মধ্যে চলে এলাম পরীমহলে। বাহির থেকে নান্দনিক দৃশ্য দেখে ভেতরে প্রবেশে অনেকটা তাড়া করছিলাম। ভেতর দৃশ্যগুলো বারবার আমাদের মুগ্ধ করছিল। ভূস্বর্গ কাশ্মীর সত্যিই অসাধারণ। আপনাকে আসতে হবে তাতে, জানতে হলে ভূস্বর্গ কাশ্মীর সম্পর্কে। ১৬৫০ সালে মুঘল স¤্রাট শাহজাহানের বড় পুত্র দারাশিকো এই পরীমহল গড়ে তোলেন। সুপ্রশস্ত বাগানঘেরা এই মুঘল স্থাপনাটি মোট সাততলা। এটি মুঘল সা¤্রাজ্যের একটি অনন্য নিদর্শন। যুবরাজ দারাশিকো এখানে লাইব্রেরি গড়ে তোলেন এবং এটিকে কেন্দ্র করেই এই বাগান। তবে শ্রীনগরের অন্যান্য মুঘল বাগানগুলোর মতো এখানে দৃশ্যমান কোনো পানির নহর বা ফোয়ারা নেই। কিন্তু পানি সংরক্ষণের জন্য জলাশয় আছে। সাততলার এই স্থাপনার একটি তলা কবুতরের জন্য বরাদ্দ ছিল। এই পরীমহলে যুবরাজ দারাশিকো জ্যোতিষশাস্ত্রের জন্য অ্যাস্ট্রলজিক্যাল স্কুল গড়ে তুলেছিলেন। যদিও শ্রীনগরের অন্যান্য মুঘল স্থাপনার মতো এটি অতটা যতেœ সংরক্ষিত নয়, তবু এখানে এলে মুগ্ধ হতেই হয়। বিশেষ করে এটি এত উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত যে পরীমহলের সামনের অংশে দাঁড়ালে পুরো ডাল লেক পাখি চোখে দেখা যায়। হঠাৎ জোহরের সুমধুর আজান ভেসে এলো। চাচা বললেন, পরীমহলের কোথাও নামাজ পড়ে নেই। আমরাও চাচার কথায় সম্মতি দিলাম। এদিকে সাদি ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে ফেলল। বিছিয়ে দিলাম বাগানের ওপর। আমাদের সঙ্গে শরিক হলেন ঘুরতে আসা আরো অনেকে। নামাজ শেষে আলিঙ্গন করলাম। মনে হচ্ছিল আপন কারো সঙ্গে আলিঙ্গন করছি। কাশ্মীরীদের আচার-আচরণ সত্যিই গল্প করার মতো। ভূস্বর্গ কাশ্মীর যেমনিভাবে পরিচিত, তদ্রƒপ তাদের আপ্যায়ন আর ব্যবহারও স্বর্গীয়। ।

বশির চাচা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, অদূরে হজরত বাল মসজিদ। সেখানে হুজুর (সা.) এর চুল মোবারক দেখানো হয় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর। তাই আমাদের গন্তব্য এখন হজরত বাল মসজিদ। আমরা সানন্দে ওঠে পড়লাম গাড়িতে। আধঘণ্টার পথ পেরিয়ে চলে এলাম মসজিদে। অজু করে মসজিদের প্রবেশ করতেই দেখলাম মুসল্লিদের ক্রন্দন শব্দ। বললাম, কাঁদছে কেন?

-এদের অনেকের স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান শহীদ হয়েছেন। তাই আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলে কাঁদছেন। বিচার চাচ্ছেন আল্লাহর কাছে। মুখটা মলিন হয়ে গেল। কতইনা কষ্ট তাদের। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র কত দুঃসহ। আসর নামাজের পর দাঁড়িয়ে আছি। প্রচ- ভিড়। চাচা বললেন, ‘এখনই হুজুর (সা.) এর চুল মোবারক দেখাবে।’ আগ্রহভরে অপেক্ষা করছিলাম। আচানক মসজিদের ইমাম সাহেব উঁচু মিনারে দাঁড়িয়ে চুল মোবারক দেখাচ্ছেন। চারপাশে কান্নার আওয়াজ। মনের অজান্তে চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। পুরোটা বুক কখন ভেজে গেছে টের পাইনি। সত্যি এমন দৃশ্য যে কাউকে কাঁদাতে বাধ্য। এভাবে অনেকটা সময় চলে গেল। মনে হচ্ছিল, স্বর্গীয় কোনো বাগানে দাঁড়িয়ে আছি। ইমাম সাহেব চুল মোবারক নিয়ে চলে গেলেন কিছুক্ষণ আগে। আমরাও নিচে নেমে এলাম। গন্তব্য এখন বশির চাচার বাসায়। পথে জিজ্ঞেস করলাম কাশ্মীরি শালের দাম কেমন? চাচা জানালেন, সর্বনিম্ন ১০০০ সর্বোচ্চ ১ লাখ রুপি। পাশেই থামিয়ে বললেন, ‘এখান থেকে কিনে নাও। স্মৃতিস্বরূপ কয়েকটি কিনেও নিলাম।

কিছুদূর এগোতেই চাচা বললেন, এটা হলো শহীদদের কবরস্থান। গাড়ি থামিয়ে দিলেন। ফটকের সামনে দাঁড়াতেই আয়াতটি নজরে পড়ল। ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হন, তাদের তোমরা মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না।’ (আল কোরআন) শ্রীনগর, কাশ্মীর ঈদগাহ্র পাশের শহীদদের কবরস্থান। যারা শহীদ হোন, সবার দাফন এখানেই করা হয়। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। প্রবেশ করলাম মাকবারায়। ভেতরে যেতেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। মনের অজান্তে শিহরিয়ে উঠলাম। সামনে এগোতেই ছয়টি কবর দেখে দৃষ্টি আর ফেরাতে পারিনি। এক সপ্তাহ আগেই শহীদ হয়েছেন ছয় ভাই। প্রতিটি কবর ভালোভাবে দেখলাম। কবর জিয়ারত শেষে ফিরে আসি আপন গন্তব্যে। রাত শেষে সকাল হতেই চাচার চোখে পানি। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন। বলছেন, ‘তোমাদের বিদায় দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আরো কিছুদিন থেকে যাও।’ আমরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কোথা থেকে এলো এই ভালোবাসা। চোখ বুঝে এলো বশির চাচা ও তার পরিবারের সদস্যদের দেখে, প্রতিটি কাশ্মীরি ভাইদের আচরণ দেখে। চলে এলাম কাশ্মীর ছেড়ে, জড়িয়ে নিলাম ভালোবাসার বন্ধনে একটি পরিবারকে, পুরো কাশ্মীরকে। কাঁদালাম, কাঁদলাম। ভালোবাসাময় সফরের ইতি হলো চোখের অশ্রু দিয়ে।

যেভাবে যাবেন : ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বিমানে দিল্লি। ভাড়া ১২ হাজার (পরিবর্তনশীল)। দিল্লি থেকে শালিমার এক্সপ্রেস ট্রেনে জম্মু। ভাড়া ৩৪৫ রুপি। জম্মু থেকে বাসে শ্রীনগর। ভাড়া ৭০০ রুপি। শ্রীনগর থেকে বাসে কিংবা মাইক্রো করে যেখানে খুশি যেতে পারবেন। ভাড়া ১০০ রুপির ভেতর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist