রাখি রায়হান

  ২১ জুলাই, ২০১৭

মানবসেবায় সিআরপি

সিআরপির জন্ম যদিও ১৯৭৯ সালে, রেজিস্ট্রেশন অর্জন ১৯৮১ সালে কিন্তু বাংলাদেশে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের নিয়ে ভেলরির কার্যক্রম প্রায় চার দশক। তিনি সুন্দর বাংলায় কথা বলতে পারেন।

ভেলেরি টেইলরকে যখন প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে কেন তিনি বাংলাদেশকে এই কাজের জন্য বিশেষভাবে বেছে নিলেন? তখন ভেলেরি বলেন, এই উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের মানুষের দরিদ্রতা, অসহায়ত্ব ও চিকিৎসার অভাবের কারণেই মূলত তিনি এ দেশকে বেছে নিয়েছেন।

বাংলাদেশে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের একমাত্র চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘সিআরপি’। পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতধারায় একীভূত করার লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী ও ফিজিওথেরাপিস্ট মিস ভেলরি এ টেইলরের নেতৃত্বে সিআরপির যাত্রা হয়। সঙ্গে সহযোগী ছিলেন একজন দেশীয় ফিজিওথেরাপিস্ট, একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ও একজন সমাজকর্মী। প্রায় চার দশক আগে ‘সার্ভিস টু সাফারার্স ইজ সার্ভিস টু গড’ স্লোগান নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একটি পরিত্যক্ত গোডাউনে মাত্র চারজন রোগী নিয়ে শুরু হওয়া সিআরপি এখন বিস্তৃত সারা দেশে। দেশ-বিদেশে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবার একটি আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। চিকিৎসাধীন সময় এবং পরবর্তীতে রোগীদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার নিরিখে যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা প্রদানই সিআরপির লক্ষ্য। সিআরপি এমনই একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবা দিতে ও ইন্টার্নি করতে ফিজিওথেরাপিস্টরা আসেন।

বাংলাদেশে সিআরপির প্রয়োজনীয়তা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ প্রতিবন্ধী। এ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ মেরুরজ্জুতে আঘাত পেয়ে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীতার শিকার হচ্ছে, যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। সিআরপিতে অন্যান্য অর্থপেডিক এবং নিউরোলজিক্যাল সমস্যার ও চিকিৎসা প্রদান করা হয়। বিশেষ করে অধিকসংখ্যক স্ট্রোক রোগী এবং সেরিব্রাল পলসি শিশু। তাদেরকে সিআরপির আন্তবিভাগ অথবা বহির্বিভাগে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

সিআরপির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

সিআরপির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোতধারায় একীভূতকরণ নিশ্চিত করে এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করা; যেখানে সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তি স্বাস্থ্য, পুনর্বাসন, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাহ্যিক পরিবেশ, বিনোদন এবং তথ্যপ্রাপ্তির সমান সুযোগ পাবে।

সিআরপি প্রতিষ্ঠা ও একজন মহীয়সী নারী ভেলেরি টেইলর

সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়কারী হচ্ছেন ভেলেরি টেইলর। ভেলেরি টেইলরের পুরো নাম ভেলেরি অ্যান টেইলর। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুমলে কেন্টে ১৯৪৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা-পিতা মেরি ও উইলিয়াম টেইলর।

১৯৬৯ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের চন্দ্রঘোনায় ভিএসও নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে স্বল্পকালীন চুক্তিতে এ দেশে আসেন যুক্তরাজ্যের ‘মেম্বার অব চার্টার্ড সোসাইটি অব ফিজিওথেরাপি-এমসিপিএস সনদধারী মিস ভেলরি টেইলর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সংকটময় সময় বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু সেখানে তার মন বসেনি। পরে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার ২ মাস আগেই তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মানবতার কল্যাণের জন্য মাতৃভূমি ও মাতৃত্বের বন্ধনও তাকে মায়ার বাঁধনে বাঁধতে পারেনি। তাই ১৯৭২ সালে এ দেশের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার জন্য ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে ড. আর জে গাস্টের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। কিন্তু অচিরেই তিনি অনুভব করেন বিভিন্নভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের মধ্যে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে চরম হতাশাজনক অবস্থা বিরাজ করছে। কেননা, তাদের জন্য নামমাত্র চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও পুনর্বাসনের কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। এরই ধারাবাহিকতায় চারজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের দুটি পরিত্যক্ত সিমেন্ট গোডাউন সংস্কার করে আলাদা চিকিৎসা কার্যক্রম চালু করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই রোগী সংখ্যা ৩৫-এ দাঁড়ালে অনিবার্য কারণে দুটি গোডাউন কক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাতারাতি তাকে রোগীদের নিয়ে ধানমন্ডির শংকরে একটি ভাড়াবাড়িতে উঠতে হয়। সেখান থেকে ফার্মগেটে তৎকালীন এম আর খান ভবন (বর্তমানে পারটেক্স ভবন)। এভাবেই রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি স্থায়ী অবস্থানের। যাযাবরের ন্যায় প্রথম ১১ বছর বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসাসেবা দিয়ে অবশেষে ১৯৯০ সালে ঢাকার অদূরে সাভারে ১৩ একর জমির ওপর মনোরম পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সিআরপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

সিআরপির জম্ম যদিও ১৯৭৯ সালে, রেজিস্ট্রেশন অর্জন ১৯৮১ সালে কিন্তু বাংলাদেশে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের নিয়ে ভেলরির কার্যক্রম প্রায় চার দশক। তিনি সুন্দর বাংলায় কথা বলতে পারেন।

ভেলেরি টেইলরকে যখন প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে কেন তিনি বাংলাদেশকে এই কাজের জন্য বিশেষভাবে বেছে নিলেন? তখন ভেলেরি বলেন, এই উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্যতা, অসহায়ত্ব ও চিকিৎসার অভাবের কারণেই মূলত তিনি এ দেশকে বেছে নিয়েছেন। ভেলেরি মাতবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এ কারণে তিনি বিবিধ স্বীকৃতি লাভ করেছেন। প্রতিবন্ধীদের জন্য তার মূল্যবান অবদানের জন্য ব্রিটেনের রানি তার বিশেষ খেতাব ‘অর্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার’ প্রদান করেছেন। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মানবকল্যাণের জন্য ১৯৬৬ সালে তিনি হল্যান্ডের ওয়ার্ল্ড অর্থোপেডিক কনসার্ন প্রদত্ত ‘আর্থার আয়ার ব্রুক’ স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। বাংলাদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে বিশেষ ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকার তাকে বাংলাদেশের সম্মানজনক নাগরিকত্ব প্রদান করে। এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা পদক (২০০৪), সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় সমাজসেবা পদক (২০০০), অন্যন্যা শীর্ষ ১০ পুরস্কার, ডা. এম আর খান ও আনোয়ার ট্রাস্ট স্বর্ণপদক (২০০০), মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড, খান বাহাদুর আহসানউলাহ স্বর্ণপদক (২০০৮), মহাত্মা গান্ধী শান্তি পদক (২০০৯), যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্র্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

দুস্থ মানবতার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ভেলেরি অ্যান টেইলর স্বদেশ, ভূমি, স্বজন ও স্বস্বার্থ ত্যাগ করে যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন, তা বিশ্ব

ংইতিহাসে দুর্লভ ।

আমাদের প্রয়োজনেই সিআরপি

প্রিয় পাঠক, সিআরপিতে সেবাগ্রহণকারীদের অধিকাংশই হচ্ছেন সমাজের দরিদ্র শ্রেণির লোক। যাদের অধিকাংশেরই চিকিৎসা ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা নেই। তাই দাতাদের অনুদানের মাধ্যমেই এদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। সিআরপির এখন নিজস্ব যে আয় আছে, তা দিয়ে চিকিৎসা খরচের কিছুই হয় না। তবে বাংলাদেশ সরকার ও সমাজে আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সহযোগিতা এখানে অত্যন্ত প্রয়োজন। আরো বিশেষ একটি বিষয় হচ্ছে, সমাজের যারা প্রতিবন্ধী তারা আপনার, আমার বা আমাদেরই কারো না কারো পরিচিত জন বা স্বজন। তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য আমাদেরকেই সিআরপির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। তাই আপনার অনুদান এবং স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সিআরপির সঙ্গে সম্পৃক্ততাকে সাদরে গ্রহণ করবে সিআরপি কর্তৃপক্ষ।

আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে সিআরপির একজন বন্ধু হিসেবে আপনাদের আগ্রহ, মনোযোগ ও অবদানের ব্যাপারে সিআরপি কর্তৃপক্ষ ব্যাপক আশাবাদী।

বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সিআরপিকে বাৎসরিক কিছু অনুদান দিয়ে থাকে। সিআরপির বাকি টাকা আসে ভেলেরি টেইলর ট্রাস্ট ও ফ্রেন্ডস অব সিআরপি থেকে। সিআরপির বাৎসরিক খরচের সিংহভাগই আসে দেশের বাইরে থেকে। বাংলাদেশের আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা যদি সিআরপির এই কাজকে আরো গতিশীল করতে এগিয়ে আসেন; তাহলে সিআরপি আরো উন্নত মানের কাজের সুযোগ পাবে। যার মধ্য দিয়ে এ দেশের বিত্তবানরা আর্তমানবতার সেবার এক বিরাট সুযোগ পাচ্ছেন।

সিআরপিতে যোগাযোগ করতে অথবা অনুদান দিতে চাইলে

পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি), বাংলাদেশ।

পো. সিআরপি-চাপাইন, সাভার, ঢাকা-১৩৪৩

ফোন : ৭৭১০৪৬৪-৫, ফ্যাক্স : ৭৭১০০৬৯

ব্যাংকের তথ্যাদি

হিসাবের নাম : ট্রাস্ট ফর দি রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড।

হিসাব নং : ০১-১২৪৫৩৩৩-০১

স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ধানমন্ডি শাখা, ঢাকা।

যোগাযোগ

ডোনার লিয়াজোঁ অফিসার

মোবাইল : ০১৭১৪-৭৮৫৮৭৮, ০১৭১৩-০১৬৫৮৭

ই-মেইল : [email protected]

ওয়েবসাইট :www.crp-bangladesh.org

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist