মাহমুদ আহমদ

  ২১ জুলাই, ২০১৭

হিমালয়-কন্যা পঞ্চগড়

এখানে আসলে সারা বছরই দেখতে পাওয়া যায় হিমালয়ের সুন্দর দৃশ্য। তবে শীতকালে হিমালয়ের দৃশ্য বেশ ভালো উপভোগ করা যায়। পরদিন সময়মতো নির্ধারিত স্থানে তারা গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। আমরা প্রথমে মহারাজার দিঘি দর্শন করার সিদ্ধান্ত নিই; যা পঞ্চগড় শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে পঞ্চগড় সদর উপজেলাধীন অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত।

বেশ কয়েক দিন থেকে খুব ইচ্ছে করছিল বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় থেকে ঘুরে আসার। কাজকর্মে এতই ব্যস্ত সময় কাটছে যে, দুদিনের জন্য সময় বের করাই যেন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অফিসের কাজকর্ম গুছিয়ে দুদিনের ছুটি নিলাম। স্বনামধন্য ভিডিও এডিটর নাদিম ভাইকে বললাম, চলুন পঞ্চগড় থেকে ঘুরে আসি। পঞ্চগড়ের কথা শোনামাত্রই নাদিম ভাই রাজি হয়ে গেলেন। আমরা যথাসময় ঢাকার শ্যামলী থেকে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে করে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে যাত্রা করি।

গাড়িতে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে দুজনের মাঝে কথা হচ্ছিল। নাদিম ভাই, জানেন পাঁচটি গড়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় পঞ্চগড়। এ জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি দ্বারা বেষ্টিত। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল বর্তমান সময়ে পর্যটনের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বিগত কয়েক দশকে চা উৎপাদনে বিশেষ করে অর্গানিক চা উৎপাদনের লক্ষ্যে চা বাগান তৈরি করার পর থেকে উত্তরবঙ্গের এক অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বহু আবর্তন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পঞ্চগড় জেলার অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত। পঞ্চগড় নামকরণেও কিন্তু রয়েছে এক ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাস। পঞ্চগড় নামকরণ সম্পর্কে কেহ কেহ মনে করেন, এ অঞ্চলটি অতি প্রাচীনকালে পুন্ড্রনগর রাজ্যের অন্তর্গত ‘পঞ্চনগরী’ নামে একটি অঞ্চল ছিল। কালক্রমে পঞ্চনগরী ‘পঞ্চগড়’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ‘পঞ্চ’ (পাঁচ) গড়ের সমাহার ‘পঞ্চগড়’ নামটির অপভ্রংশ ‘পঞ্চগড়’ দীর্ঘকাল এই জনপদে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলের নাম যে পঞ্চগড়ই ছিল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। অবশ্য বহুল প্রচলিত মত, এই অঞ্চলের পাঁচটি গড়ের সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই পঞ্চগড় নামটির উৎপত্তি। গড়গুলো হচ্ছে-ভিতরগড়, মীরগড়, হোসেনগড়, রাজনগড় ও দেবেনগড়। ষোড়শ শতকে কুচবিহার রাজ্য গঠিত হওয়ার পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পঞ্চগড় অঞ্চল মূলত কোচ রাজন্যবর্গের দ্বারাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পঞ্চগড় থানাটি দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও মহকুমার পাঁচটি থানা তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারী, বোদা ও দেবীগঞ্জ নিয়ে পঞ্চগড় মহকুমা সৃষ্টি হয়। মহকুমার সদর দফতর পঞ্চগড় থানায় স্থাপিত হয়। এ জেলার তিন দিকেই সীমান্ত। এ সীমান্ত অঞ্চল ১৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত। গল্প করতে করতে কিভাবে যে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে বুঝতেই পারছি না। রাস্তায় গাড়ির চাপ বেশি থাকায় পঞ্চগড় পৌঁছতে বেশ সময় লাগা সত্ত্বেও খারাপ লাগছিল না, বরং ভালোই লেগেছে। বিশ্রাম ও খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে নাদিম ভাইকে নিয়ে পঞ্চগড় বাজার, রেলস্টেশন, করতোয়া নদীসহ আরো কিছু উল্লেখযোগ্য স্থান দর্শন করি।

রাতেই ঠিক হলো মাসুদ, জাফর ও শের আলী ভাইসহ পঞ্চগড় সদর থেকে ভোরে বাংলাবান্ধার উদ্দেশে যাত্রা করব। যেখানে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ সম্ভাবনাময় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা; যা ভারত, নেপাল ও ভুটানের খুব কাছে অবস্থিত। শুধু তাই নয়, এখানে আসলে সারা বছরই দেখতে পাওয়া যায় হিমালয়ের সুন্দর দৃশ্য। তবে শীতকালে হিমালয়ের দৃশ্য বেশ ভালো উপভোগ করা যায়। পরদিন সময়মতো নির্ধারিত স্থানে তারা গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। আমরা প্রথমে মহারাজার দিঘি দর্শন করার সিদ্ধান্ত নিই; যা পঞ্চগড় শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে পঞ্চগড় সদর উপজেলাধীন অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত। এই মহারাজার দিঘি একটি বিশালায়তনের জলাশয়। পাড়সহ এর আয়তন প্রায় ৮০০দ্ধ৪০০ গজ। পানির গভীরতা প্রায় ৪০০ ফুট বলে স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস। পানি খুবই স্বচ্ছ। দিঘিতে রয়েছে মোট ১০টি ঘাট। ধারণা করা হয় পৃথু রাজা এই দিঘিটি খনন করেন। কথিত আছে, পৃথু রাজা পরিবার-পরিজন ও ধনরতœসহ ‘কিচক’ নামক এক নিম্ন শ্রেণির দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়ে তাদের সংস্পর্শে ধর্মনাশের ভয়ে ওই দিঘিতে আত্মহনন করেন। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষে এই দিঘির পাড়ে মেলা বসে। মেলায় সীমান্তের ওপাড় থেকেও অজ¯্র লোকের সমাগম ঘটে। বিশাল এই দিঘির চারপাশে গাছগাছালির সবুজের কারুকার্য, সৌম্য-শান্ত পরিবেশ; যা এখনো সবার কাছে বিরল মনে হয়। পুকুরের পানি আর পাড়ের উঁচু ঢিবিতে বিশাল বিশাল গাছের ডালে হাজার হাজার পাখি। সারা দিন কলতানে মুখরিত থাকে প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো এই দিঘি। শীতে পরিযায়ী পাখিদের আগমনে এখানে অসাধারণ এক আবহের যোগ হয়। সেসঙ্গে চেনা দৃশ্যও বদলে যায়।

মহারাজার দিঘির মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে এতই ভালো লাগছিল যে, ডিএল রায়ের সেই বিখ্যাত গানটি অবলিলায় ঠোঁটে এসে যায় : ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা/তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা/ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।/এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি/সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।’ ঠিক তা-ই। এখান থেকে এবার বাংলাবান্ধার দিকে যাত্রা। মহারাজার দিঘি থেকে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের দূরত্ব ৪০কিলোমিটার। যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশে একটি হোটেলে সকালের নাশতার পর্বটি সেরে আবার যাত্রা করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই হিমালয়ের তিব্বত পর্বতের প্রাকৃতিক সুন্দর দৃশ্য দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। পঞ্চগড় জেলা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বলে এই জেলাকে বলা হয় ‘হিমালয় কন্যা’। ওই পাড়ে ভারত আর এপাড়ে বাংলাদেশ মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে মহানন্দা নদী। দুই দেশকে ভাগ করেছে এই মহানন্দার স্রোতের পানি। আমরা বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে খুব সুন্দরভাবে পৌঁছে গেলাম। বাংলাবান্ধার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা নিরিবিলি পরিবেশ আমাদেরকে ক্ষণিকের জন্য হলেও দিয়েছে অনাবিল আনন্দ। তবে হিমালয়ের প্রকৃত মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে হলে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তেঁতুলিয়ায় যেতে হবে। তেঁতুলিয়া ও বাংলাবান্ধা কাছাকাছি।

এ ছাড়া তেঁতুলিয়ায় আরো রয়েছে ছোট-বড় অনেক চা বাগান। পাহাড় ছাড়াই প্রতিটি চা বাগান গড়ে উঠেছে সমতল ভূমিতে। একটি শহরকে পর্যটননগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে উপাদান প্রয়োজন তার সবই বিদ্যমান রয়েছে পঞ্চগড় জেলায়। পঞ্চগড় জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাংলাদেশের যেকোনো জেলার চেয়ে ভালো। আমরা দেখেছি, পঞ্চগড়ের মানুষজন অতি সহজ-সরল এবং অতিথিপরায়ণ। পঞ্চগড়ে রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র রকস মিউজিয়াম। রয়েছে মহানন্দা নদীতীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক ডাকবাংলো; যেখান থেকে দুই বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বেশ কিছুক্ষণ বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের শেষ প্রান্তে সময় কাটিয়ে আবার গন্তব্যের দিকে রওনা হই। এবার ঢাকায় আসার পালা। পঞ্চগড় রেলস্টেশন থেকে ঢাকার টিকিট নিয়ে যথাসময়ে অত্যন্ত আরামের সঙ্গে ঢাকায় পৌঁছি।

যোগাযোগব্যবস্থা : সড়ক বা রেলপথে রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি বাস বা ট্রেনে পঞ্চগড় যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে সড়কপথে পঞ্চগড় যেতে হলে শ্যামলী, কলেজ গেট অথবা গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে পঞ্চগড়গামী দিবা কিংবা রাত্রিকালীন বিভিন্ন পরিবহনের কোচ সার্ভিস রয়েছে। ভাড়া ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া রেলপথে যেতে হলে ঢাকা কমলাপুর স্টেশন থেকে দিনাজপুরগামী আন্তনগর ট্রেনে ওঠে শাটল ট্রেনে চড়ে সোজা পঞ্চগড়। আর যারা বিমানপথে যেতে চান; তারা ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর পর্যন্ত বিমানে এসে এরপর বাসে দেড় ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে পঞ্চগড় যেতে পারেন।

থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা : পঞ্চগড় শহরে অসংখ্য বিভিন্ন মানের অসংখ্য হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। যেগুলোর ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist