হুমায়ুন মালিক

  ২১ জুলাই, ২০১৭

গল্প

শিল্পীর শিকার

এইতো পরিবেশ নিজের সঙ্গে নিজের গভীর পরিচয়ের। এমন নিবিড় নির্জনতায়, এমন উদাস করা কাব্যিক পরিবেশে নিজের ভেতর থেকে পরমকে বাইরে এনে ইজেলে মূর্ত করা যায় নিটোলভাবে। মফস্বলের ছোট্ট শহর। এত ছোট যেন শহরই বলা চলে না। আর এই নদীর ধারে শহরের একপাশের বাংলোটি যেন বড় বেশি নিঃসঙ্গ একা। তবে এ নির্জনতাই তো কাম্য শিল্পী হাসানের। চিন্তাশূন্য-কর্মহীন অবসরে আকাশ-প্রকৃতির আরো কাছাকাছি নিভৃত মহলে হৃদয়কে ছড়িয়ে গভীরভাবে অনুভব করতে পারবে।

আজও অফিস ফেরার পথে দেখেছে মেয়েটিকে। তখন বিকেলের নরম রোদ প্রথম ভালোবাসার অনুভবের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ওপারের হাওয়ায় দোলানো বটের পাতায়, এই ছোট্ট নদীর বুকে আর এপারের কাঁকর বিছানো পথের দুই ধারে ঘাসের ডগায়। এ মেয়ে আর পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী যেন হাসানের মনে এক সুরের স্বরলিপি হয়ে বেজে চলে। নদীও যেন ভালোবাসাকাক্সক্ষী যৌবন ছোঁয়া কিশোরীর মতো যতদূর পারে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে ভালোবাসার সোহাগী পরশটুকু নিতে চায়। তাই তো পারের ধানখেতগুলো পেরিয়ে গ্রামের বাড়িঘর ছুঁয়ে তার বিস্তার। আর গ্রামটিকে একান্তভাবে জড়িয়ে রাখতে পারে না বলেই বুঝি ওর বুকের জল অশ্রুর মতো ছলছল করে।

হাসান ভেবেছিল কাজের মেয়ে রাবুকে বদলে অন্য কোনো মেয়েটেয়ে রাখবে; কিন্তু না। খোঁজখবর, যোগাযোগ সব কিছুই এর দ্বারা করানো সম্ভব হবে। তার চালচলন সে ধাঁচেরই। অফিসের বেয়ারাটা আসলেই চোরা গল্প জমায়। রাবুর গায়ের রং মল্লিকা ফুলের মতো হলুদ। আঁটসাঁট ব্লাউজে যেন যৌবন আটকে রাখতে পারে না। তাকে দেখলে কেমন অস্বস্তিবোধ করে ও। যদিও তার আচার-আচরণ, কথাবার্তা মার্জিতই। এর উপস্থিতিতে মনের প্রসন্ন সুরভি হারিয়ে যায়। সূর্যালোকে দূরের আকাশের টগর ফুলের অজস্র পাপড়ির সঞ্চয় ভরা মেঘ, দেয়ালের পাশে ইউকেলিপ্টাসে এলোমেলো হাওয়া, নদীর আবাহন, নিসর্গের ছবির অনুভূতি-সব মিলিয়ে মনের ঝিমঝাম পরিপাট্য কেমন এলোমেলো হয়ে যায় ও ঘরে এলেই।

কিরে ওই রাস্তার পাশে বাগানওয়ালা বাড়িটি কার?

এইহানের ইশকুলের হেড মাস্টারের।

বাড়িতে ওই মেয়েটি কার?

ও ফারজানা আপা! মাস্টার চাচার মেয়ে। ও না আপনার... মেয়েটি অতিরিক্ত উৎসাহ দেখায়, কী ভেবে আবার থেমে যায়।

কী, আমার কী?

আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছিল।

কী কথা!

আপনে বিয়া করেছেন কি না।

তুই কী বললি?

বললাম, বিয়ে করলে বউ তো সঙ্গেই থাকত।

ঠিক আছে। নে, এই ১০ টাকা তুর বকশিশ। ওকে বলবি, ওর জন্যই তুই বকশিশ পাচ্ছিস।

হাসানের চেহারায় সতেজ তারুণ্যের উদ্ধত ছাপ। তার চোখ-মুখের মুদ্রার বয়স আসল বয়স থেকে অনেক কম।

পরদিন অফিসে যাওয়ার সময় মেয়েটিও যাচ্ছিল ইশকুলে। হাসান বারবার পেছন ফিরে দেখেছে। ‘মুখখানি তার নতুন চরের মতো’ নয়- সে মুখ অনন্ত সৌন্দর্যের নিবিড় উপত্যকা, সহস্র বসন্তের সঞ্চিত পুষ্পের অবয়ব নয়, শুধু তার রূপের সবটুকু স্নিগ্ধ আলো এসে নিভৃতে-নীরবে থেমে আছে। তাতে ছড়িয়ে আছে সহস্র বসন্তের সঞ্চিত মধু নয়, তার মাধুরীর সুধাটুকু। সে তো শুধু নয়ন ভরে দেখার নয়, হৃদয় দিয়ে অনন্ত অনুভবের।

ফেরার সময় যে চমৎকার ঘটনা ঘটেছে তাকেই রঙতুলির আঁচড়ে মূর্ত করার চেষ্টা করছিল জাহিদ হাসান।

কটা ফুল নিতে পারি? গাঁদা-ডালিয়ার কেয়ারিতে জল ঢালছিল ফারজানা।

নিন। লাজুক চোখ তুলে ছোট একটি জবাব দিল ফারজানা।

কিন্তু আমি যে ওসব ফুল নয়, তোমার ভালোবাসার বাগানে ফুল কুড়াতে এসেছি, হাসান আবদার করে-দেবে!

ফারজানা লজ্জাবতী লতার মতো নিজের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায়। কিন্তু কতটুকু পারে! চোখে-অধরে-গন্ডদেশে-গ্রীবাসহ পুরো মুখাবয়বে ফুটে ওঠে প্রথম ভালোবাসার উন্মুখ ভীরু হৃদয়ের অনন্ত আবেগের প্লাবনের অদ্ভুত মায়া ছবি। এমন মধুর রহস্যময় সৌন্দর্যের প্লাবনের দৃশ্যকে ধরে রাখতে হবে ক্যানভাসে।

সৌন্দর্য সৃষ্টিই শিল্পী জাহিদ হাসানের মূল লক্ষ্য। তাই তার শিল্পের পটভূমি প্রেম আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। প্রেমে পড়লে প্রকৃতি অন্য মোহন গভীর রূপ নিয়ে ধরা দেয়, অনুভূতি হয় গভীর-তীক্ষèè।

নারীর প্রেম প্রকৃতিগত কারণেই ভীরু, দুর্বল। সংগত কারণেই তাকে সাহস দিতে হয়, উৎসাহ দিতে হয়। আর তার জন্য বকশিশলোভী চতুর রাবেয়া তো কাজ করে যাচ্ছেই। কৌশলে জাল গুটিয়ে তুলছে রাবু, জাহিদ ভাবতেই পারেনি রাবু এত শিগগিরই তার শিকার বাগে এনে দেবে।

ফারজানা সন্ধ্যায় নদীর ওপারে পাখি শীৎকার, রাতের একলা পাখির আকুলতা, জ্যোৎস্নাবিধৌত রাত্রির অজস্র লীলা-সব কিছুর ভেতর এক অনন্ত মধুর অস্ফুট আকুলতা ছড়িয়ে দিয়েছে।

কত করে বললাম ভয়-লজ্জা এসব মুছে প্রতি রাতে এসে দেখা করে যাবে...।

জানেন তো, কেউ জেনে ফেললে কী কলঙ্কটাইনা রটবে। এখানে বাবার একটা আলাদা স্ট্যাটাস আছে। কিছু একটা ঘটলে বাবা লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারবেন না আর আমি তখন বিষ...।

আহ! আজ লাজুক কথার কুঁড়ি মুখর হয়ে ফুটছে। ও হ্যাঁ, তোমার দীর্ঘ পত্রটি পড়লাম। চিঠিতে যেন পৃথিবীর গোপনতম-মধুরতম সব ইচ্ছা বাস্তবায়িত হওয়ার আকুলতায় মাথা কুটছে অসাধ্যের প্রাচীরে। এত গভীর তোমার রক্তে আমার উপস্থিতি! ইচ্ছা করলে তুমি আমাকে নিয়ে চমৎকার একটি কাব্য লিখতে পারতে, যা কালজয়ী হয়ে থাকত।

আমি তো তোমাকে নিয়ে কথা-ছন্দের কাব্য লিখতে চাই না, রচনা করতে চাই সংসার-কাব্যের সুখ-ছন্দের গাথা।

কিন্তু সে কাব্য তো কালজয়ী হবে না।

না হোক, কালজয়ী কিন্তু তোমাকে এক জন্মের জন্য পাওয়া, সে আমার কত বড় পাওয়া... আবেগে চোখের পাতা কাঁপতে থাকে ওর। লজ্জাহীনের মতো এত কিছু বলে বসে আছে বোধ হওয়ায় লজ্জায় লাল হয়ে যায় ফারজানা।

এক দিন রাতে জাহিদ হাসানের রুমে পৌঁছতে না পৌঁছতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। জাহিদ হাসান ফারজানাকে জড়িয়ে ধরল। ফারজানা অস্বীকৃত।

জান, প্লাটনিক ভালোবাসায় আমার মোটেও আস্থা নেই। প্রেমিকের অনন্ত আকুলতা তো ছড়িয়ে আছে দেহের ঐশ্বর্য ঘিরে... তবে আর তোমাকে কেন? একটা নৈর্ব্যক্তিক সুন্দর মূর্তি কল্পনায় গড়ে ভালোবাসলেই হলো। এটা কি সম্ভব? ফ্রয়েডের মতে, তাই শুধু আত্মায় আত্মায় যোগাযোগ হলে মিলন অসম্পূর্ণ, ভালোবাসাও অগভীর, অতৃপ্ত। তাই চাই দেহে দেহে, আত্মায় আত্মায়, পরাগে পরাগ মাখার গভীর তৃপ্ত শিহরণে সম্পূর্ণ উন্মুখ মিলন। লক্ষ্মী বোঝ না কেন, তুমি তো আমারই হবে।

কিন্তু হেমলেটে তো আছে, মানুষ তার জৈবিক রসনাকে মেটানোর জন্য যত রকম যুক্তি দেখায়, ওয়াদা-অঙ্গীকার করে; কিন্তু ওগুলো আসলে রসনা পরিতৃপ্তির কপট অস্ত্র মাত্র।

কী আশ্চর্য! এত কিছু জান। হেমলেটও পড়েছ দেখছি।

পড়িনি। বাবা পড়ে বাংলায় অনুবাদ করে শুনিয়েছেন।

যাই হোক, হেমলেটের কাহিনিটা কিন্তু নির্ভেজাল সত্য। যদিও প্রায় ৪০০ বছর আগের লেখা, তবু তোমাদের ওফেলিয়ারা আজও অনর্থক অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে ভুগে ভুগে আমাদের মতো অভাগা হেমলেটদের বানায় উন্মাদ। সত্যি সত্যি দুর্বলতাই হচ্ছে রমণীর নাম। যাক তবে। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে ভালোবাসাও নেই। তবে দুঃখ, যে মেয়েটিকে এত করে ভালোবাসলাম, যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখলাম-সে আমাকে ভালোবাসে না।

বলতে বলতে জাহিদ হাসান ফারজানার জামার ভেতর দিয়ে নগ্ন স্তনে হাত রাখে।

কোনো জাদুকাঠির প্রথম স্পর্শেই ফারজানার পুরো দেহমন অমোঘ নেশাগ্রস্ত হয়ে হাসানকে জড়িয়ে ধরে। হাসান চুম্বনে চুম্বনে আশ্চর্য শিহরণ ছড়িয়ে দেয়। তার সুনিপুণ, অভিজ্ঞ হাত ঘুরে বেড়ায় দেহের আনাচে-কানাচে। ঘরে তখন নির্লজ্জ আলো পান করে তাদের অনন্ত দৃশ্যাবলি। হাসান অদ্ভুত এক নগ্নতায় দেখে ফণা তোলা সাপের ছোবল উন্মুখ পটভূমি।

যে করেই হোক বদলির ব্যাপারটা শিগগিরই করে ফেলতে হবে। রাবেয়া জানিয়েছে ফারজানা অন্তঃসত্ত্বা। জাহিদের এক কন্যা পিঙ্কি। তার স্ত্রী সুমা ওই কন্যাসহ তার সঙ্গে এখানেই থাকতে চেয়েছিল; কিন্তু জাহিদ রাজি হয়নি। নানা অজুহাত দেখিয়েছে। মফস্বল শহর। চোর-ডাকাতের ভীষণ উপদ্রব। খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা। অন্তত পিঙ্কির স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ রেখে ওখানে না যাওয়াই ভালো। তাছাড়া ঢাকায় কোনো অসুবিধা তো হচ্ছে না তাদের ইত্যাদি।

শিল্পী জাহিদ হাসান প্রেম করেছে শিল্পের প্রয়োজনে। ঘর-সংসারের প্রয়োজনে তো সুমা আছেই।

জাহিদ হাসান যেমন নিঃসঙ্গ এসেছিল, তেমন নিঃসঙ্গই বিদায় নেয়। নিঃশব্দে। নির্বিঘেœ।

শিল্পী জাহিদ হাসান জীবনে একটার পর একটা প্রেম করেছে শিল্পের প্রয়োজনে, জীবনে বৈচিত্র্যময় বিলাসের প্রয়োজনে। এমন সমস্যা অবশ্য আগে হয়নি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist