সোহেল নওরোজ
হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প
সাহিত্যের বড় বিস্ময়
বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য কথাকার হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্টির অজস্রতায় ঋদ্ধ। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার মানুষটি অসামান্য পরিমিতবোধে বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনকে নতুন করে আবিষ্কারের প্রয়াস পেয়েছেন। তার নানামুখী সৃষ্টির মধ্যে ছোটগল্পের অবস্থান নিরূপণের কাজটি অত্যন্ত দুরূহ। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে অধিকাংশ মানুষের পরিচয় ঘটেছে তার উপন্যাস, নয়তো নাটক-সিনেমার মাধ্যমে। তার উপন্যাসই মূলত তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। পরবর্তীতে নির্মাণে এসে পাঠকের সঙ্গে দর্শকদেরও বেঁধে ফেলেছেন অদৃশ্য মায়াজালে। আমার ক্ষেত্রে হুমায়ূনপ্রীতির অনেকাংশজুড়েই অবশ্য রয়েছে তার ছোটগল্প, কারণ হুমায়ূন পাঠ এবং মুগ্ধতার পাশাপাশি চলতে শুরু করেছিল ‘সৌরভ’ নামক একটা গল্প পড়ার পর। তখন থেকেই মূলত তার ছোটগল্পের নিবিষ্ট পাঠক বনে যাই। গল্প বলার ক্ষেত্রে যে বিশেষ ধারা তিনি তৈরি করেছিলেন, তা একেবারেই স্বতন্ত্র, সহজপাঠ্য এবং সর্বোপরি বিস্ময়কর। হুমায়ূনের গল্প মানেই মুগ্ধতার বলয়ে এক এক করে জমা হতে থাকা একেকটি জীবননাট্য। যে নাট্যের অংশ হয়তো আমি নিজেই কিংবা আশপাশের পরিচিত কেউ! কিংবা কে জানে হয়তো লেখক নিজেই! হুমায়ূন আহমেদের কিছু উপন্যাস পড়ে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার খেদ থাকলেও তার ছোটগল্প কখনো আমাকে নিরাশ করেছে বলে মনে পড়ে না।
হুমায়ূন আহমেদ কী ছিলেন-এ প্রশ্নের উত্তর অনেকভাবে দেওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে জুতসই জবাব বোধহয়-তিনি গল্পের মানুষ ছিলেন। অতি সহজ আর স্বকীয় ভঙ্গির মধ্যে কী এক জাদু মিশিয়ে লিখেছেন একের পর এক গল্প, যা পড়ার পর রেশ হুট করে কেটে যায় না। জীবন-বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না বলেই হুমায়ূনের গল্প নানাভাবে, নানা কারণে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। অজান্তেই একটি নীল বোতামের খোঁজে হাত চলে যায় বিছানায় অথবা বালিশে। ‘চোখ’ পড়ার পর কান্না লুকানোর চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হতে হয়। ‘রুপা’ যে বিভ্রান্তিতে ফেলে অন্তর্গত ভালোবাসা আর হাহাকার একসঙ্গে উসকে দেয়, তার তুলনা কোথায়? এখনো মনে হয়, যদি কখনো সুযোগ পাই ‘নন্দিনী’কে হানাদারের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথ করে দেব। ‘খেলা’তে জীবনের পরাজয় না জয় দেখলাম, তা নিয়ে বিস্তর ভেবেও কূলকিনারা পাওয়া যায় না। ‘জুয়া’, ‘জীবনযাপন’ পড়েও অভিন্ন অনুভূতি হয়েছে। ‘খবিস’, ‘খাদক’ বাস্তবতার যে নির্দয় চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে মন খারাপের নানা অনুষঙ্গ গিজগিজ করে। তবু অস্বীকার করা যায় না কোনোটাই। আধিভৌতিক, কল্পবিজ্ঞান এসেছে বাস্তবতার সমান্তরালে। নিষ্ঠুর ব্যাপারগুলোকেও তিনি যেভাবে বিশ্বাসযোগ্য রূপ দিয়েছেন, তা কেবল বিস্ময় বাড়িয়ে দেয়। ‘অচিন বৃক্ষ’, ‘উইজা বোর্ড’, ‘ভয়’, ‘জিন-কফি’, ‘নিজাম সাহেবের ভূত’, ‘মৃত্যুগন্ধ’, ‘নিমধ্যমা’ ইত্যাদি গল্পে খুঁজে পাওয়া যায় অদ্ভুত সব প্লট; যার সঙ্গে বাস্তবতা হয়তো সবসময় মিলবে না। কিন্তু একটা আশঙ্কার ¯্রােত ঠিকই বইয়ে দেবে-এই বুঝি ঘটল বলে!
নামহীন কোনো উপন্যাস পড়তে দিলেও প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরই যেমন বলে দেওয়া যায় এটা হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি; তেমনি ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য সেগুলো সহজেই চিহ্নিত করা যায়। বেশির ভাগ গল্পই তিনি ফেঁদেছেন আপন খেয়ালে। যেখানে হয়তো তার অজান্তেই নিজেকে তুলে এনে গল্প সাজিয়েছেনে, তাতে ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলনও পাওয়া গেছে কোথাও কোথাও। কিংবা উত্তম পুরুষে লেখার যে সুবিধা আর স্বাধীনতা তা হারাতে চাননি বলেই সচেতনভাবে সে ধারায় লিখে গেছেন। তার ছোটগল্পে আরোপিত বিষয় একেবারেই কম, তাড়াহুড়া নেই বললেই চলে। ধীরে ধীরে গল্পে ঢুকেছেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে যেন কেবলই চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা বর্ণনা করে যাচ্ছেন! একসময় হঠাৎ করেই তা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। পাঠক নড়েচড়ে বসেন। চেনা দৃশ্যপট কেমন যেন অচেনা হতে শুরু করে! এরপর চিন্তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তাতে কখনো আবেগ এসে মেশে কিংবা হাহাকার যুক্ত হয়। বুকের গভীরে একটা দাগ কেটে যায়, পাঠককে তা বয়ে বেড়াতে হয় ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়।
হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের বড় বিস্ময়। বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার গল্প হুমায়ূন আহমেদ তুলে এনে সহজ, সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় পরিবেশন করেছেন। ব্যক্তি-মানুষের আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আবেগ-অভিমান, হতাশা-বঞ্চনার মতো মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা-কিছুই বাদ পড়েনি তার রচনায়। ব্যক্তিজীবনের নিতান্ত সাদামাটা ঘটনা থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবনের বহুমাত্রিক টানাপড়েনের চিত্র সুনিপুণভাবে ওঠে আসে তার গল্পে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পে লেখকের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বেদনা প্রবলভাবে উপস্থিত, যা সমগ্র জাতির দুঃখ, বেদনা ও সংগ্রামের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। গল্প বলার ক্ষেত্রে একদিকে তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা, অন্যদিকে আপসহীন। এ ক্ষেত্রে লেখালেখিতে তার ব্যক্তিজীবনের প্রভাব ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হয়। গল্পের চরিত্রগুলো নিয়ে যে খেলা তিনি করেছেন কলম হাতে, জীবনের পটে এসেও তেমন খেলা করেছেন কখনো পেশা কখনোবা নেশা নিয়ে। তাতে সাফল্যও মিলেছে ঢের। তাই রাতারাতি রসায়নের শিক্ষক থেকে বনে গেছেন জনপ্রিয় নাট্যকার।
নিজের রচনাকে জনপ্রিয় করে তোলার কলাকৌশল হুমায়ূন আহমেদের মতো খুব কম লেখকই পেরেছেন। তাই পাঠক বা দর্শকপ্রিয়তার বিচারে কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক অনেকে থাকলেও তার মতো জনপ্রিয় লেখক বাংলা ভাষার ইতিহাসে খুব বেশি আসেনি। তার সব সৃষ্টি একত্রে বিবেচনায় না নিলেও আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি শাখায় তিনি ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছেন। এই যেমন তার গল্পের বিষয়-বৈচিত্র্য দিয়ে পাঠককে ভাবিয়েছেন, কখনো রূঢ় হয়ে মনকে কাঁদিয়েছেন, কখনো অনুভূতির কোষগুলোকে জীবন্ত করে দিয়ে বানিয়েছেন আবেগী। এ এক আশ্চর্য হুমায়ূনী চক্র! হুমায়ূন আহমেদ সার্থকভাবে সে চক্র নির্মাণ করে গেছেন। পাঠক বহু দিন তার সে চক্রে নিজেদেরকে খুঁজে ফিরবে। আনন্দ-বেদনার এ সত্যিই এক মহাচক্র! ক্ষুদ্র কিন্তু তুচ্ছ নয়-ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বড্ড মানানসই কথাটাই এসে যায় ঘুরেফিরে। হুমায়ূন আহমেদের গল্প পড়ে বারবার মনে হয়, তাইতো! কপালের টিপ, শার্টের বোতাম, জুয়ার তাস, সিলিং ফ্যান কিংবা পারফিউমের গন্ধ-গল্পের প্রয়োজনে তুচ্ছ নয় এর কোনো কিছুই!
"