রণেশ মৈত্র

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

ভাষা আন্দোলনের বহুমুখী বিজয়

ই ১৯৪৮ সালের কথা। মাত্র এক বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান। সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ উত্থানের পটভূমিতে ভারতবর্ষ খ-িত হয়। যে ভয়ঙ্কর রকমের উগ্র সাম্প্রদায়িক আবহ ওই পাকিস্তান আন্দোলনের কারণে সৃষ্টি হয়েছিল তার রেশ বহুলাংশে দুর্বল হয়ে আসে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই।

উল্লেখ্য, ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে। আর বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীনের দাবিতে গণআন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৯৪৮ সালের মার্চে। এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের মূলে প্রচন্ড আঘাত হানে। আমার কাছে মনে হয়, এটি একটি আশ্চর্যজনক এবং বিশাল তাৎপর্যবহ ঘটনা। আশ্চর্যজনক ঘটনা বলছি এ কারণে যে মুসলিম লীগ ও তার নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অবিভক্ত ভারতবর্ষে ভারতজুড়ে মুসলিম সমাজের মধ্যে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ নামে গঠন করে হিন্দুদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার দাওয়াই এমনভাবেই মগজে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল যে একযোগে বাংলার মুসলিম সমাজ পাকিস্তানের পক্ষে ১৯৪৬ সালে ভোটও দিয়েছিলেন।

তার ফলেই পাকিস্তান সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭ এর আগস্ট থেকে মার্চ, ১৯৪৮ এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হতে মাত্র ৬/৭ মাস সময় লেগেছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর। হিন্দু মুসলিম তরুণ-তরুণীরা মিলিতভাবে এই আন্দোলন সংগঠিত করে তাতে শরিক হন। এটি সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের (যার ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল) গালে প্রথম চপেটাঘাত। ইসলামী জোশকবলিত পাকিস্তানে তখনো তা ছিল কল্পনাতীত। তবে মৌলবাদী ইসলামপন্থিরা তখনো মিছিলে আক্রমণ করেছে। পুলিশও তাতে সহযোগিতা করেছে। তারা বলেছিল, ‘বাংলা হলো ইসলাম ও পাকিস্তানবিরোধী ভাষা’। এতে অবশ্য ফল হয়েছে উল্টোটা। আন্দোলনকারীরা ভাষা আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তুলতে কঠোর প্রত্যয় নিয়ে দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গড়ে তোলার কর্মসূচি নেয়। জেলায় জেলায় থানায় থানায় তারা ছড়িয়ে পড়েন এবং সংগঠন গড়ে তোলেন।

আন্দোলন জিইয়ে রাখার তাগিদে প্রতি বছর ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের কর্মসূচির ঘোষণাও করেন আন্দোলনকারীরা। ওই কর্মসূচি পালনের জন্য জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়। গণ অর্থ সংগ্রহ করার এ প্রক্রিয়ায় ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে অজস্র লিফলেট প্রকাশ ও বিলি করা হয় গোপনে। লিফলেট ছাপাতেও হয়েছে গোপনে, প্রেস থেকে আনতে হতো গোপনে, বিলিও করতে হতো গোপনে। মানুষ অবশ্য আগ্রহের সঙ্গেই পড়তেন গোপনীয়তা বজায় রেখে পড়ার পর তা লুকিয়ে রাখতেন বা পুড়িয়ে ফেলতেন। অর্থ সংগ্রহের জন্য আমরা অনেক কৌটা হাতে নিয়ে কখনোবা কাপড় টান টান করে ধরে হাটে-বাজারে অর্থ সাহায্য তুলতাম। খুব কম সংখ্যক লোক বাদে সবাই সাধ্যমতো পয়সা কড়ি দিতেন। তরুণীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন কেউ কেউ হাতের বা গলার সোনার গহনা পর্যন্ত খুলে আগ্রহের সঙ্গে তা দিয়ে দিতেন।

যেসব তরুণরা মাত্র এক বা দুই বছর আগেও ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে ইসলামী রাষ্ট্রের দাবিতে বাংলার দিকদিগন্ত মুখরিত করে তুলতেন, তারাও ধারক হয়ে উঠলেন বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বাঙালিত্বের। অভিভাবকরাও ধীরে ধীরে পাকিস্তানের মোহ থেকে মুক্ত হয়ে ভাষা আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থক ও পরিণতিতে মুসলিম লীগের ঘোরবিরোধী হয়ে উঠতে লাগলেন। এগুলোর ফলে একটি আদর্শবাদের নতুন করে উত্থান ঘটতে শুরু করল বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের সেই প্রথম যুগ শেষ হতে না হতেই। সেটি হলো অসাম্প্রদায়িকতা। ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা, দেশ বিভাগ ইত্যাদি নিয়ে হিন্দু ও মুসলিম তরুণ-তরুণীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। কেবল তা-ই নয় তারা যেন বহুলাংশে পরস্পরের অঘোষিত শত্রু হয়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। সেই হিন্দু-মুসলিম তরুণ-তরুণীরাই মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানে আবার একে অপরের হাত ধরে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা আন্দোলনে জীবনমরণ পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের বিশালত্ব ও গভীরতা আজ কল্পনাতেও আনা দুঃসাধ্য। সেদিনকার ঘোর সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরতন্ত্রী বাঙালিবিরোধী সরকারের সীমাহীন অপপ্রচার ও নিষ্ঠুর দমননীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বাঙালি তরুণ সমাজের নেতৃত্বে গোটা পূর্ববাংলা ঐক্যবদ্ধভাবে ফুঁসে উঠেছিল অকাতরে। বুকের রক্ত কালো পিচঢালা রাস্তায় ঢেলে দিতে সক্ষম হয়েছিল, ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক বিজয়ের ভিত্তি ভূমি রচনা করতেও সাফল্যের সঙ্গে সক্ষম হয়েছিল। যে অসাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ধীরে ধীরে ১৯৪৮ থেকে ঘটতে শুরু করেছিল ভাষা আন্দোলনের উন্মেষকাল থেকে তা দিব্যি দিনে দিনে বিকশিত হতে হতে ১৯৫২ তে পরিপক্বতা অর্জন করে দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষাক্ত আদর্শকে পরিত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের লক্ষ্যে দৃঢ় পদক্ষেপে যাত্রা শুরু করে। যেন স্বাধীন বাংলাদেশের ধারণার ভ্রƒণও বায়ান্নর আন্দোলনের গর্ভে লুকিয়ে লুকিয়েই চুপিচুপি বেড়ে উঠতে শুরু করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীও তা বুঝেছিল ঠিকই। তাই তারা একদিকে যেমন দমন রীতির স্টিমরোলার চালিয়ে যেতে থাকল, তেমনই আবার তারা জঘন্য অপপ্রচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টায়ও মেতে উঠল। শাসকগোষ্ঠীর বশংবদ সংবাদপত্র, বেতার প্রভৃতির মাধ্যমে ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রচার করা হতে থাকল ‘ইসলামবিরোধীরা ঢাকায় তৎপর হয়ে উঠেছে’, ‘পাকিস্তান ধ্বংস করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে’, ‘ভারতের দালালেরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে’, ‘হিন্দুরা তাদের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী উত্থাপন করেছে’, ‘বাংলা মুসলমানের ভাষা নয়’, ‘বাংলাভাষা ইসলামবিরোধী’ ইত্যাদি।

কংগ্রেস নেতা ধীরেন দত্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের করাচি অধিবেশনে ১৯৪৮ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা ঘোষণা করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বাংলাবিরোধী প্রচারণার জন্য তথাকথিত মৌলবাদী ইসলামী লেবাসধারীরা ধীরেন দত্তের উদাহরণ টানা শুরু করে এটাকে ধর্মীয় মোড়ক দেওয়ার চেষ্টা করল। জবাবে ঢাকার ছাত্র সমাজ ধীরেন্দ্রনাথকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধিত ও মালা ভূষিত করল।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মিছিলের সরকারী প্রচারণায় বলা হলো, ‘পশ্চিমবাংলার ধুতি পরা হিন্দুদের ঢাকার একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলে দেখা গেছে’ যা ছিল নির্জলা মিথ্যা এবং সে কারণেই ধরা পড়ার ভয়ে তারা ওই মিছিলের ছবি ছাপাতে গোপন নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। কিন্তু মানুষ বিভ্রান্ত হননি। এমন কী ওই ধরনের নোংরা অপপ্রচার মানুষের মনে সামান্যতম সংশয়েরও সৃষ্টি করেনি। বরং ভাষা আন্দোলন দিনে দিনে ব্যাপকতা অর্জন করেছে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়তেও শুরু করেছে। এমনকি ‘ইউনিয়ন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামেও সংগঠন গড়ে উঠেছে।

এবারে দেখা যাক, বায়ান্নের যে আন্দোলন এত ব্যাপকতা অর্জন করেছিলÑ তার তাৎপর্য এবং প্রভাব বাঙালির জীবনযাত্রায় তার শিক্ষা-দীক্ষায়, তার সংস্কৃতি-চেতনায় ও চর্চায় কতটা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। এ কথা শুরুর আগেই বলে রাখতে চাই, ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলনে আমি ছিলাম মিছিলের একজন অংশগ্রহণকারী মাত্র। কিন্ত বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে পাবনার সাংস্কৃতিক সংগঠন শিখা সংঘের পক্ষ থেকে যেমন অংশগ্রহণকারীÑ তেমনই একজন সচেতন সংগঠকও। তাই বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চেতনা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ওই অগ্নিঝরা দিনগুলোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মিলিয়ে যথেষ্ঠ দৃঢ়তা নিয়েই সেদিনের কথাগুলো লিখছি।

আমার কাছে ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যময় দিকগুলো হলোÑ ক. দমননীতি ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে এ আন্দোলন ঠেকাতে গিয়ে সমগ্র পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ এবং সাম্প্রদায়িক দলগুলো জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে;

খ. জনগণের মনে সরকার বদলের লক্ষ্যে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জনপ্রিয়তা লাভ করে;

গ. মুসলিম লীগ ও সাম্প্রদায়িক দলগুলো জনমতের ভয়ে ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং প্রকাশ্য সভা সমিতি ও অন্যান্য অনুষ্ঠান লক্ষণীয়ভাবে কমিয়ে ফেলে।

এবারে দেখা যাক ভাষা আন্দোলন বাঙালি জীবনে নানা ক্ষেত্রে কেমন প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।

এক. সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রবর্তন প্রচলনের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে;

দুই. দোকানপাটের সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে ছাত্র নেতারা ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানালে তারা তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়ে ইংরেজি-আরবি বদলে সাইনবোর্ডগুলো বাংলায় লিখিয়ে নেন;

তিন. মাতৃভাষার মাধ্যমে সব স্তরের সব বিষয়ের শিক্ষা প্রচলনের দাবি সার্বজনীন দাবিতে পরিণত হয়;

চার. পর্দার অন্তরালে লুকিয়ে পড়া বাঙালি সংস্কৃতি প্রাণ ফিরে পায়; তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ও বিস্তার দ্রুততর হয়;

পাঁচ. ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন বন্ধ হয়ে যায় এবং রাজনৈতিক, ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলো ক্রমান্বয়ে তাদের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ পরিত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাদের প্রধান লক্ষ্য বলে ঘোষণা করতে শুরু করে;

ছয়. সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক অনুষ্ঠানে জড়তা ও স্থবিরতা কেটে উঠতে থাকে এবং নতুন নতুন এ জাতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হতে থাকে।

সাত. সংবাদপত্রগুলো (নতুন করে আত্ম প্রকাশের ক্ষেত্রে) বাংলা নামে প্রকাশ হতে শুরু করে;

আট. নাট্যাভিনয়ে নারীর ভূমিকায় মেয়েরা অভিনয় করতে শুরু করে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল; নারী মুক্তি আন্দোলনও নতুন গতি পেতে শুরু করে;

নয়. একুশে ফেব্রুয়ারি ব্যাপকভাবে উদ্যাপিত হতে শুরু করে এবং সর্বত্র শিক্ষাঙ্গনে শহীদ মিনার স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্মাণ হতে শুরু করে;

দশ. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ হয়ে যায়, হিন্দুদের দেশত্যাগের মাত্রা লক্ষণীয়ভবে কমে আসে;

১৯৫৪ তে এসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাতে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। যুক্তফ্রন্টের তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় সূচিত হয় এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে যা ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close