অজিত কুমার দত্ত

  ১৪ এপ্রিল, ২০১৭

বর্ষবরণ : বাঙালি ও বাংলাদেশ

বর্ষবরণ শব্দটা নিতান্ত ক্ষীণ অর্থেই মানুষ ব্যবহার করে থাকে। তন্মধ্যে আবার বিভিন্ন জাতি-সম্প্রদায় বিভিন্ন রূপে পরিচর্চা করে। যেমন- শিল্পীগোষ্ঠী সঙ্গীতে, কলাকৌশলী বিভিন্ন কালচারাল অনুষ্ঠানে নববর্ষকে বরণ করে থাকেন। মূলত অকৃত্রিমভাবে বর্ষবরণ করে বাঙালিরা আর সেটা হয় গ্রামগ্রামান্তরে পল্লীর প্রত্যেক পরতে পরতে প্রাকৃতিকভাবে এবং লোকজন আন্তরিকভাবে প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়েই তা করে থাকে।

আমরা কথায় কথায় বলে থাকি, সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ। সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো কৃত্রিম। মানুষ শস্য ফলায়, গাছ-গাছালি লাগায়, বন-বাদাড় সৃষ্টি করে বনায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে। মূলত বর্ষবরণ- প্রকৃতিই প্রকৃতিকে বরণ করে নেয়। তার কিছু ছোঁয়া লাগে অধিবাসীদের জীবনে। শীতের প্রকোপে মুহ্যমান প্রকৃতি যখন কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির নির্মমতা থেকে বেরিয়ে আসে, প্রকৃতিতে তখন দোলা দেয় প্রাক-বসন্তের হাওয়া।

ভৌগোলিক প্রভাবে বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। স্পষ্টত এখানে ধরা পড়ে ষড়ঋতুর ষড় রূপ, ষড় গুণ, ষড় ঐশ^র্যের প্রাচুর্য। শুভ প্রকৃতির মাঝে প্রত্যক্ষভাবে পরিলক্ষিত হয়। নবপুষ্প মঞ্জুরি, পল্লব-পত্র, কুঁড়ি। বসন্ত বিষুবে বা বসন্ত ঋতুতে প্রকৃতি সাজে নানা রূপে, নানা ঢংয়ে, হাজারো রঙের হাজারো ফুল ফোটে বনে-বাদাড়ে, হাজারো পাখির হাজারো কণ্ঠে ধ্বনিত হয় হাজারো সুর, কখনো আগমনী বা বিষাদি, কখনো নিনাদিত-সেই সুর লহরি জনমনে আনে হর্ষ, কখনো বিষাদ, কখনো আনন্দ লহরি। জনজীবনে ঢেউ খেলে সেই লহরি আনমনা হয়ে পড়ে। মানুষ নিজের অজান্তে প্রস্তুত হয় দুঃখবিষাদ-একঘেয়েমি-নীরব-নিস্তব্ধতাকে পাশ কাটাতে, মানুষ আপন মনে খোঁজে ব্যতিক্রম কোনো আনন্দ, কোনো নতুনত্বের আস্বাদন। তাই তো মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে হাত মেলায় বসন্ত বিষুবকে বা নববর্ষকে বরণ করে অতীতকে ভুলে যেতে।

বর্ষবরণ তিনটি ধাপে বাঙালিকে পালন করতে হয়। এটা কোনো সংস্কৃতি নয়, নিজ প্রয়োজনে জীবন ধারণের একান্ত তাগিদে তা করতে হয়। এক. বিষুব বা হাড় বিষুব, দুই. সংক্রান্তি বা শেষ অংশ বা ক্রান্তিকালের শেষ দিন, তিন. নববর্ষ বা নতুনের সম্ভাষণ।

যে যেভাবেই নববর্ষ উদযাপন করুক না কেন, বাংলা মানে বাঙালিরা ঐতিহ্যগতভাবে তা করবেই। বাঙালি কেন? প্রতিটি সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষই তার জীবন-সংসারে এসব কাজ প্রতিপালন করবেই বা করতে হবে। আর এ জন্যই বিষু-সংক্রান্ত বর্ষবরণ একে অন্যের পরিপূরক। একটিকে ছাড়া অন্যটি চলে না বা অচল। নববর্ষ মানেই বসন্ত বিষুব, চৈত্র সংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে কতজন, কত মনীষী, কত রকমের সংজ্ঞা, কত রকমের উৎপত্তি গাথা রচনা করে স্মরণীয় ও বরণীয় হওয়ার চেষ্টা করেছেন বা করছেন। কিন্তু অতীত বাদ দিয়ে তা হবে না। কারণ প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে নিজেরা নিজেদের অহঙ্কার কর্মক্ষমতার পরাকাষ্ঠায় ক্ষমতার দম্ভে নিজের মতো করে নববর্ষ বরণকে সাজিয়ে নিয়েছেন নিজের কীর্তি স্থাপনের জন্য। কেউ কেউ বাংলা নববর্ষকে ইংরেজি সালের সঙ্গে মেচিং করাতে চেয়েছেন, কেউ ডিক্লারেশন দিয়েছেন, কেউ ১৪ এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষ বলে চিহ্নিত করে কীর্তিমান হতে চেয়েছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলা নববর্ষ বাংলা সনের প্রকৃতিগতভাবে নির্ধারিত হয়। কিন্তু বাঙালি, বাংলা, বাংলার প্রকৃতি চিরদিনই অভিন্ন, অভেদ আপসহীন। নিজ গতিতেই ধাবমান প্রকৃতির সঙ্গে মিলেই তারা উদযাপন করে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ।

এক. মহাবিষুব বা বিষুর বা বসন্ত বিষুব যখন এ দেশে ইংরেজ, ইউরোপীয়, আরবীয়, পর্তুগিজ, চেঙ্গিস, আলেকজান্ডার, মোগলরা আসেনি তখন যেভাবে বাংলায় নববর্ষ উদযাপিত হতো আজও সেভাবেই হচ্ছে। শহরের বাবুরা মা-বাবা, বাড়িঘর ছেড়ে উন্নত জীবনযাপনের জন্য শহর-নগর-বন্দরের পত্তন করেছেন। কাজেই তারা গ্রামের সেই প্রাকৃতিক ঘটনা আর স্বাভাবিকতাকে অস্বাভাবিকতা, অবান্তর গেঁয়ো মূর্খের আচার-আচরণ বলে মনে করেন। নতুন করে নতুন কালচারের নামে অশালীন কৃত্রিম অবাঙালি কালচারের সৃষ্টি করেছেন। যেমন-বসন্তের শেষ প্রহরে দোয়েল, কোয়েল, পাপিয়া, ফিঙ্গে, চড়ুই, মাছরাঙা, বউকথা কও, তিলে ঘুঘু, চিল কোরকা, কাক, ডাহুক, কোকিল-এমন হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখরিত পরিবেশ ভুলে থাকতে শহরের কোনো গাছতলায় বসানো হয় গানের আসর। ঊষার আবীর ছড়ানো রঙের বিকল্প রঙে আমোদিত করার জন্য নতুন পোশাক পরে লোকজন, সে তো গেল একপক্ষ। বনে বনে ফোটে লাখো প্রজাতির সুরভিত লাখ লাখ, কোটি কোটি ফুল গন্ধরাজ, বেলি, চামেলি, ছাতিম, সোহারি, হিজল, বনবিহারী, পঞ্চ পাপড়ি, শতদলী, টগর, অসংখ্য গুল্ম ফুল, গোক্ষুর, থোকা বেলি, ভাট আরিয়া আর কত রঙ, কত আকার, কত সৌরভ, সে যেন অগণন উপলব্ধির অগোচর।

প্রকৃতির সে সাজের সঙ্গেই চলে ঘরের আসবাবপত্র, তৈজসপত্র ধোয়া-মোছার কাজ, ঘর ঝাঁট দেওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। সঙ্গে চলে শরীর-মন নীরোগ রাখার জন্য প্রাকৃতিক ভেষজ তৈরি এবং রান্না করে খাওয়ার পালা। সারা বছরের জারণ রোগব্যধির বিষনাশক কচু-ঘেচু, ঘেট-কচু পঞ্চতিক্ত (পাঁচ ধরনের), বোট বেগুন, গিমা, উচ্ছে, নিম, বেতের অগ্রভাগ, এমনি আরো কিছু তিক্ত পদার্থের মিশ্রণে, তিক্তভাজা, রোগ নিবারণী ভেষজ খেয়ে অতীতের যন্ত্রণা রোগ-শোককে বিদায় জানাত।

দুই. সংক্রান্তি বা ক্রান্ত অংশ বা চৈত্র মাসের শেষ দিন বিগত বছরের কর্ম-ক্লান্তির পর একটু অবসর। শরীরকে তাপজনিত কারণে কর্মক্লান্তির কারণে সেদিন চলে না রান্নাবাড়ার কাজ। পুরো বাংলার ঘরে ঘরে চলে দুধ-দধি, নাড়–-মুড়ি, চিড়া-খই পাটালি গুড়ের সঙ্গে কলা মেখে খাওয়া, সকালের নাশতায় চলে বাংগি (ফুটি), তরমুজ, অকালে আসা কাঁঠাল, খিরা, শসার শীতল পরশ, তারপর চলে পুকুরে জাল ফেলে ইচ্ছামতো মাছ ধরা, পছন্দমতো মাছ কাটাকুটি, সন্ধ্যাবেলায় আম-ডালের সঙ্গে তরতাজা মাছের ভাজি, দুপুরের অবশিষ্ট দধি, বনফুলে মালা গেঁথে সাজানো হয় ঘর-দোর।

যার অকৃত্রিম প্রয়োগস্থলে শহরে চলে পান্তা ভাত, শুঁটকি আর মরিচ পোড়া। বাঙালিকে আর কত নিচে নামানো হবে, শহুরে বাবুরা, নব্য নববর্ষের উদযাপনের উছিলায় এসব করে থাকে। মূলত পান্থা-ইলিশ গ্রামবাংলার কৃষ্টি নয়। তার মূল কারণ হলো আমরা শিকড়ের সন্ধান হারিয়ে ফেলেছি। মনে পড়ে ডি.এল রায়ের কবিতাংশ- ‘একটা নতুন কিছু কর, একটা নতুন কিছু কর, কানগুলি সব কাট, নাক গুলি সব ছাঁট, পা গুলি সব উঁচু করে মাথা দিয়ে হাঁট...।’ যারা ক্ষমতায় থাকে, যারা উঠতে চায় হামাগুঁড়ি দিয়ে অপ-কালচারের লেজ ধরে, তারা এমনভাবেই বাংলার কালচার নিজের মনমতো করে তুলে ধরে। বিশে^র কাছে কান কাটে বাংলার আর বাঙালির।

তিন. অনেক ধোয়া-মোছা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পর আসে মহা হরষে সেই নববর্ষ ‘পহেলা বৈশাখ’। যারা কিনতে পারে না তারা পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পরে মসজিদে যায় মুসলমান, মন্দিরে পূজা দিতে যায় হিন্দুরা। বউ-বাচ্চা নিয়ে গ্রামের মেলায় হাঁড়ি-পাতিল, চালুন, কুলা, টুরকি, বড় মাছ, হলুদ-রসুন, পুতুল, খেলনা আর জিলিপি কিনে ফিরে আসে বাড়ি। দুপুরে চলে বড় মাছের কালিয়া, মিষ্টি দধি, মুগ ডালের সঙ্গে বড় মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট, আম-ডাল, আমের চাটনি, ঘরের গাভীর দুধ আর কালো জিরা বা গোবিন্দ ভোগ চালের গাঢ় পায়েস। সঙ্গে একখানা রাজভোগ, চমচম আর পানতোয়া খাবারের পর ফল, তারপর মিষ্টি দধি ইত্যাদি।

গাছতলায় পাতা শীতল পাটি বা বিছানায় গড়াগড়ি, সঙ্গে চলে গল্পগুজব। রাতে হয়তো কোনো বাড়িতে চলে রামায়ণ বা কবিগানের আসর। কোনো বাড়িতে চলে গাজী কালু, চম্পাবতীর পুঁথি পাঠ বা মনসা মঙ্গল, পার্বতীর পালাগান ও কিচ্চা কাহিনি। এভাবে মননশীলভাবে বরণ করা হয় নতুন বর্ষ বা পহেলা বৈশাখকে। গ্রাম্য মেলায় বসত বাঁশি, হাঁড়ি-পাতিল, ফুটি-তরমুজ, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, মাটির ঘোড়াসহ নানা তৈজসপত্রের দোকান। সারি বেঁধে বসত বিভিন্ন রকম ও সাইজের ঘুড়ি ও সুতার দোকান, প্যা-প্যা, ভুঁ ভুঁ করে বাঁশি বাজিয়ে পথেঘাটে চলত কিশোরদের কাফেলা। এভাবে অনুষ্ঠিত হতো বর্ষবরণ।

আধুনিকতার নামে ব্যান্ড গান, অশালীন পোশাক-আশাক, উচ্ছৃঙ্খলতায় বর্ষবরণ হয় না। বরং বাংলা-বাঙালির এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতা বাঙালি জাতিকে বিশ দরবারে করছে অপমান, কাজেই সর্বস্তরের জনগণ ও বাঙালিদের কাছে নিবেদন রাখছি- আপনারা বাঙালি হোন, বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃৃতিকে বাঁচিয়ে রাখুন, এতে দেশ ও জাতির যেমন মঙ্গল হবে, তেমনি বাঙালি তার ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist