বিশ্বজিত রায়

  ১৪ এপ্রিল, ২০১৭

বাঙালি দর্শনে বাংলা নববর্ষ

স্বা গত ১৪২৪। বছর ঘুরে আবার এসেছে বাংলা নববর্ষ। বাঙালির প্রাণে তাই উৎসবের আমেজ। গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর- সবখানেই বঙ্গবর্ষের উল্লাস উদযাপন। বৈশাখী আল্পনায় সেজেছে পুরো দেশ। আবালবৃদ্ধবনিতার দেহ-মনে শুধুই রঙিন আভা বিরাজমান। ষোড়শী কন্যা গায়ে জড়িয়েছে বৈশাখী শাড়ি, আল্পনায় মোড়ানো দেহসারা, মাথায় পুষ্প টোপর, কানে দুল, পায়ে পায়েল, হাতে বাহারি রঙের চুড়ি, গলে মালা, মুখে হাসির আনন্দবার্তা জানিয়ে দিচ্ছে বর্ষবরণের বঙ্গ বাহাস। অপরূপ তনয়ার সাজগোছ আর বাঙালি ঐতিহ্যের স্মারক বাংলা নববর্ষ মাতাল বানিয়েছে বঙ্গ বালকের ভাবুক মন। যৌবনের পূর্ণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে যুববয়সী মানুষটিও সাজতে ভুল করেনি যুবতী নন্দিনীর একটু পাশে দাঁড়াতে। বড়দের পিছু ছুটতে ছোট্টরাও নতুন আঙ্গিকে নবরূপ ধারণ করেছে। বৈশাখের প্রথম দিন নিজেদের করে নিতেই বাঙালির ধুমধাম এই ব্যস্ততা।

সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নববর্ষের রং ছড়িয়েছে লেখক-কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিকের মনেও। পহেলা বৈশাখ কিংবা বাংলা নববর্ষকে নিয়ে তারা লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, গান ও গল্প। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখায় বৈশাখকে স্বাগত জানিয়েছেন এভাবে- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা/রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করি দাও আসি,/আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ/মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক/এসো হে বৈশাখ! এসো এসো।’ কবিগুরুর বিখ্যাত এই গানটিতে পুরনোকে পেছনে ফেলে নতুনকে বরণ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বৈশাখ সম্পর্কে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল তেমন কিছু না লিখলেও তিনি বলেছেন- ‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি/এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোন এক মিলনের বাঁশি।’ অর্থাৎ, জাতীয় কবি নজরুল বোঝাতে চেয়েছেন, এই বৈশাখই সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করাতে পারে। বাংলা বর্ষের প্রথম দিনটিতে সব প্রান্তের সব প্রাণ একই সুরে গেয়ে ওঠে- ‘শুভ নববর্ষ’। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন চৈত্রের খরতাপে বৈশাখকে ডেকে লিখেছেন- ‘চৈত্র গেল ভীষণ খরায় বোশেখ রোদে ফাটে/এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ালে নামলো না গাঁর বাটে।’ চৈত্রের পর বৈশাখেও যখন রৌদ্রতাপ, তখন পল্লীকবি গরম থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছেন ছন্দময় লেখার মাধ্যমে। সুকান্ত ভট্টাচার্য দার্শনিক মনে বৈশাখকে মিনতি জানিয়েছেন- ‘এস এস এস হে নবীন, এস এস হে বৈশাখ এস আলো,/এস হে প্রাণ ডাক কালবৈশাখীর ডাক’। কবি যেমন স্বাগত জানিয়েছেন তরুণকে, তেমনি সুন্দর আলোকাচ্ছন্ন একটি বৈশাখ রয়েছে তার চাওয়ার মাঝে। আবার প্রাণ খুলে কালবৈশাখী ঝড়কেও ডেকেছেন সুকান্ত তার লিখনির মাধ্যমে।

ঐতিহ্য, অহঙ্কার ও অসাম্প্রদায়িকতার মিলনমেলায় পুরো বাংলাদেশ ভাসে অন্য রকম এক মহা-আয়োজনে। বাঙালির প্রাণের মেলা বাংলা নববর্ষ যেন সবাইকে শেখায় আপাদমস্তক বাঙালি বনার প্রমিত ভাষা, চিন্তা-চেতনায় বাতলে দেয় শুদ্ধ চর্চা, পৃথিবীর বুকে পরিচয় করিয়ে দেয় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের খুঁটিনাটি বিষয়াদি। বিশ্ব ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠতম স্থানটি দখল করতেও ভুলে যায়নি বাংলা নববর্ষ। আমরা আমাদের পুরো বাঙালিত্ব খুঁজে পাই এই দিনটিতে। সবাই মন-প্রাণ উজাড় করে মিলিত হই একই কাতারে। দেশব্যাপী ওঠে আওয়াজ- ‘শুভ নববর্ষ’। গায়ের ছোট্ট কুটির থেকে শহরের বিশাল অট্টালিকা কিংবা গেঁয়ো পরগনার মাঠঘাট পেরিয়ে ভিনদেশি বাঙালির গায়েও লাগে বৈশাখীদিনের নয়া গীতি। বঙ্গভূমের প্রতিটি প্রাণ যেন সজীবতা ছড়িয়ে ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন হয়ে ওঠে। ঘরে

ঘরে মুড়ি-মুড়কি ও মিষ্টি খাওয়ার মহোৎসবে মাতোয়ারা বাঙালি রসনাতৃপ্তি মেটাতে মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন খাবারের আয়োজনের মধ্য দিয়ে নববর্ষকে আরো উপভোগ্য

করে তোলে।

বছরের পর বছর বাঙালি এভাবেই পালন করে আসছে পহেলা বৈশাখ, অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ। তবে বাংলা বর্ষবরণের অতীত-বর্তমান পর্যালোচনা করলে বেরিয়ে আসে পৃথক প্রেক্ষাপট। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই বাঙালি রীতির রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র। যেমন, দুই যুগ আগের দেখা নববর্ষ আর বর্তমান আধুনিক জমানার বর্ষ উদযাপনে অনেক ব্যবধান লক্ষণীয়। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে হালখাতায় মিষ্টিমুখ, অতঃপর মেলার মাঠে গিয়ে মাটির খেলনা হাতি, গরু, ঘোড়া, পুতুল, ডেগ এবং কড়াইসহ বিভিন্ন সামগ্রী কিনে সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফেরা; বাড়িতে অপেক্ষমাণ মায়ের রান্নাকৃত মাংস খেয়ে খেলতে যাওয়া। অতীতের সেই তরতাজা স্মৃতিগুলো এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় নিজেকে। কিন্তু সেদিনকার সেই বর্ষবরণের দৃশ্যপট আর এখনকার চিত্র এক নয়। এখন নববর্ষ আসে ঠিকই, তবে তার রেশ আগের মতো নয়। এর মধ্যে বেশকিছু বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়।

বঙ্গ-ঐতিহ্যের অন্যতম গর্বিত আকর্ষণ বাংলা নববর্ষ। দিন যত যাচ্ছে, বর্ষবরণের রং-রূপ ততই পাল্টাচ্ছে। অনেক অনুষঙ্গই হারিয়ে গেছে ঐতিহ্য স্মারক বাংলা নববর্ষ থেকে। বৈশাখের প্রথম দিন গ্রাম-গঞ্জের মাঠে-ময়দানে এখন আর মেলা বসে না অতীতের মতো; মাটির খেলনা ও নকশায় মোড়ানো রঙিন হাঁড়ি-পাতিলের পসরা সাজিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের সুযোগ খোঁজে না কুমার মহাজন; বাউলে সেতারি সুরে ওঠে না তাল; থেমে গেছে নাগরদোলার ঘূর্ণন গতি; গ্রামীণ হাট-বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জমে না হালখাতার মিষ্টি আসর; পাড়া-মহল্লার শৌখিন মানুষগুলো খাসি কেটে মাংস বিক্রির আনন্দ আড্ডা থেকে দূরে সরে গেছে; পল্লীপ্রান্তে দুরন্ত কিশোরের নাটাই হাতে ঘুড়ি ওড়ানোর চিরচেনা দৃশ্যও নেই; নেই ষাঁড়ের লড়াই ও ঘোড়দৌড়ের মতো বিনোদনধর্মী কোনো প্রতিযোগিতা।

বর্ষ ভাবনা থেকে হারিয়ে গেছে গ্রামীণ খেলা হা-ডু-ডু, মোরগের লড়াই, লাঠিখেলা, ভাগ্য গণনা, বানরের খেলা, যাত্রাপালা, কবিগান, গাজীর গান, পুতুলনাচ, নৌকাবাইচ, দৌড় প্রতিযোগিতা কিংবা ফুটবল খেলার উৎফুল্ল আয়োজন।

বাংলা নববর্ষের মহামিলনমেলায় পরিণত হয়েছে ঢাকার রাজপথে বের হওয়া বিশাল মঙ্গল শোভাযাত্রা, যদিও এটি প্রায় ৩০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তবে এই মাঙ্গলিক পদযাত্রার হাতে হাতে শোভা পায় আবহমান বাংলার রং-রূপ ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক। মঙ্গল শোভাযাত্রার বিশাল বহরে হাতে হাত ধরে আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পরিচয় ফুটিয়ে তুলি। বিশ্বকে জানিয়ে দেই মঙ্গল বারতা। এ যেন অন্য এক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন প্রাণী-পশু-পাখির মোড়কে আবৃত জড় বস্তুগুলো শোভাবর্ধন করলেও বঙ্গ বাস্তবতায় প্রকৃত বর্ষসাধ পাওয়া অনেকটা অসম্ভব।

আমরা কেবল আধুনিকতায় মেতেছি; নিজস্ব সংস্কৃতির পূর্ণ মূল্যায়ন করতে ভুলে

যাচ্ছি সবাই।

বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে বিলীন হতে চলেছে অনেক কিছুই। ভিন্ন সংস্কৃতির আবির্ভাব, আধুনিক প্রযুক্তির অবাধ নাচানাচি কিংবা মানুষের চিন্তা-চেতনায় লুকিয়ে থাকা অসুস্থ ভাবধারা গর্বিত বঙ্গবর্ষের অহঙ্কারী অনুষঙ্গগুলো তাড়িয়ে গেড়েছে স্থায়ী আসন। বৈশাখের প্রথম দিনে আমরা যতই বাঙালি বনার অহেতুক প্রচেষ্টা চালাই না কেন, মনে-প্রাণে কে কতটুকু বাঙালি, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। বঙ্গীয় বর্ষের আসল উপলক্ষ ছেড়ে সবাই মেতে উঠি ভ্রান্ত পান্তা-ইলিশ ও ভিনদেশি সুর-সঙ্গীতের উতালা নৃত্যে, যা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ধারেকাছেও

ছিল না বলে জানা গেছে।

ছোটবেলার বৈশাখী প্রথম দিনের অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে। হাওরজুড়ে নতুন ধানের সোনালি হাসি; গাছে গাছে আ¤্র কচির ম-ম গন্ধ; দেশের দূর সীমানা থেকে ধান কাটতে ছুটে আসা মানুষের ভিন্ন ভাষার কলরব; ধানিজমির কান্দা পারে জেগে ওঠা হিজল-করচের আনন্দ জাগানিয়া উন্মত্ত উল্লোল; পুরনো বর্ষ বিদায়ের শেষ দিনের গোধূলিবেলায় গোয়াল-ফেরত গরুর পাল এবং তার পেছন পানে অশান্ত রাখালের পথমাতানো দুষ্টুমি- সবই যেন বাংলা বর্ষকে কাছে টানার নির্মল প্রস্তুতি। বিশ-বাইশ বছর আগের সেই পহেলা বৈশাখ স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠা কাল্পনিক বাস্তবতা ছাড়া আর কিছুই নয়। বৈশাখ আবাহনের এই তৎপরতা আজ নেই বললেই চলে। এখন বৈশাখ আসে ঠিকই, তবে ভিন্ন সাজে,

ভিন্ন ঢঙে।

‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’- কবির পঙ্ক্তিমালায় ভর করে বঙ্গরাজ্যে বৈশাখ বিলিয়ে দেয় তার নিজস্ব ঋতুবৈচিত্র্য।

কিন্তু আমরা এই ঐতিহ্য লালনে কতটা যতœশীল। বাঙালি খাঁটি পরিচয়ের কেউ যেন শতাধিক বছরের পুরনো ঐতিহ্য বাংলা নববর্ষের সুস্থ সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত না হই। সবার মাঝে বাংলা নববর্ষ এবং পহেলা বৈশাখকে মনে-প্রাণে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে বাঙালিত্ব রক্ষার সুস্থ চেতনা জাগ্রত করতে হবে। বাঙালিয়ানার শতভাগ সত্যতা এবং টেকসই ঐতিহ্য রক্ষায় বাংলা বর্ষের নতুন দিনটি হতে পারে সর্বোত্তম সুযোগ। আসুন, সম্মানের গভীর জায়গা থেকে বলি- শুভ নববর্ষ। সবাইকে পহেলা বৈশাখের নিরন্তর শুভেচ্ছা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist