অরূপ তালুকদার
নববর্ষ : আবহমান বাংলার ছবি
সেই প্রাচীনকাল থেকে বাংলার মানুষের জীবনায়ন, মন-মানসিকতা ও প্রাণের সঙ্গে যেন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহীধারা।
আবহমান বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এ দেশের কোটি কোটি মানুষ ধারণ করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। বাঙালি জীবনের এই সাংস্কৃতিক চেতনা যেন এক অবিনাশী ধ্রুবতারার মতো চিরদিন পথ দেখিয়ে চলেছে আমাদের জন্ম থেকে জন্মান্তরে। আমাদের সামগ্রিক জীবনায়নের ক্ষেত্রে এ এক অনির্বচনীয় আনন্দধারা। এর তো বিকল্প কিছু নেই। বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম মাস। এ মাসের প্রথম দিনটি পহেলা বৈশাখ। নববর্ষের শুরু। এ দিনটি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে শুধু নয় বরং বলা যায়, সমগ্র বাঙালি জাতির জীবনে এক নব জীবনের উজ্জ্বল বার্তা বয়ে আনে। আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি আর জীবনায়নে চিরায়ত এই যে অমলিন অসাম্প্রদায়িক উৎসবের আনন্দ এর সঙ্গে বছরের আর কোনো দিনেরই তুলনা হয় না, তুলনা হয় না অন্য কোনো উৎসব, আয়োজনেরও।
তাই এই সার্বজনীন উৎসবের দিনটিতে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবাই একযোগে মিলিত হয় পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর সব ক্লেদ, দুঃখকষ্ট, হানাহানি আর ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক নতুন আনন্দ মেলায়। পহেলা বৈশাখের আনন্দোজ্জ্বল প্রভাতে মুক্ত-নির্মল জীবনে প্রবেশের আনন্দ আর আকাক্সক্ষায় প্রতিটি বাঙালি জীবন মন তখন যেন উন্মুখ হয়ে থাকে। বৈশাখের এই প্রথমদিনটির সব উজ্জ্বলতা যেন উৎসব হয়ে ধরা দেয় আনন্দঘন এক নতুন রঙের আবাহনে।
এই দিনটিকে আমরা আবাহন করি সভা, কবিতা পাঠ, গান, নৃত্য আর নানা রকম অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে, এই কার্যক্রম, এই ধারণাই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই দিনটি পরবর্তী সময়ে, প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে আমাদের জীবনে নতুন নতুন প্রেরণার উৎস হয়ে। তাই নববর্ষ চিরদিন বাঙালি জাতির চিরায়ত কৃষ্টি আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। একটি জাতির প্রধান পরিচয় ফুটে ওঠে তার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্য দিয়েই। আমাদের শিক্ষা, সংগীত, নৃত্যকলা, শিল্প-সাহিত্য সবকিছু মিলিয়েই আমাদের সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যার উত্তরাধিকার এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি আমরা।
আমরা আজ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। এ দেশের মানুষ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে সেই একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকে। যার পেছনে ছিল আবহমান বাংলার মুক্ত রাজনৈতিক চেতনা আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিবিড় বন্ধন। প্রকৃতপক্ষে, এ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মানসিক জাগরণই আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। তাদের মন ও মানসের পূর্ণতাই প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি। বর্তমান বিশ্বের আধুনিক মানুষ আজ বিজ্ঞানের হাত ধরে অতি দ্রুতই যেন পালটে ফেলতে চাইছে পুরোনো সব ধ্যান-ধারণাকে। খুলে দিতে চাইছে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার। আর স্বাভাবিকভাবেই এই আধুনিক ধ্যান-ধারণা, দ্রুততার ছায়াপাত ঘটেছে আমাদের আজকের দিনের শিল্প-সাহিত্য থেকে সংস্কৃতির অন্য মাধ্যমগুলোয়ও। যার কারণে মানুষ পুরোনো জীর্ণতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য ডাক দিয়েছে সবাইকে নতুন করে। মানুষের জীবনধারা, স্বাভাবিকভাবেই, ক্রমেই পরিবর্তিত হতে থাকে তার কর্মের মধ্য দিয়ে, চিন্তাভাবনা আর ধ্যান-ধারণার উত্তরণের মধ্য দিয়ে, খুঁজে পেতে চায় আরেক নতুন জীবনকে। এ নতুন জীবনে এসে সে তার আজীবনের চেনা কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে নতুনভাবে গ্রহণ করতে চায়, তৈরি করে নিতে চায় নিজের মতো করে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। পাশাপাশি আমাদের এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের স্বাধীন দেশটির যে বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো গ্রামাঞ্চলবাসী, তারাও কোনো দিন কি ভুলে যেতে পারবে রাখালি বাঁশির মেঠোসুর, মন উদাস করা জারি, সারি, ভাটিয়ালি আর ভাওয়াইয়া গানের প্রাণ আকুল করা সুরের মোহময় জাদু?
বাংলার মানুষের প্রাণের শেকড় ডুবে আছে যে মাটিতে, তাকে অস্বীকার করবে কে? আবহমান বাংলার যে সংগ্রামী রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক চেতনা, উত্তরাধিকার আমরা বহন করে চলেছি যুগ যুগ ধরে, তাকে ধরে রাখাই হোক আমাদের এই নববর্ষের অঙ্গীকার।
"