প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
বন্যাদুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট
দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও কিছু কিছু জায়গায় নদ-নদীর পানি বেড়ে এবং বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এখনো পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ। এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি ও খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তীব্র সংকট চলছে গো-খাদ্যেরও। ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত নানা রোগ। সরকারি, বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা চললেও বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য তা অপ্রতুল। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
চাঁপাইনবাবগঞ্জ : চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিন নদীÑপদ্মা, মহানন্দা ও পুনর্ভবায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানি বেড়েছে তিনটি নদীতেই। তবে এখনো পদ্মার পানি বিপদসীমার নিচে থাকলেও মহানন্দা ও পুনর্ভবা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর পদ্মায় পানি বৃদ্ধির কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ৩ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির ফসল। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল ইসলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জে বড় ধরনের বন্যা না হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। গত শনিবার ভোর ৬টা থেকে গতকাল রোববার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলার গোমস্তাপুরে পুনর্র্ভবা নদীর পানি ২২.৪৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৬২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর মহানন্দায় সকাল ৬টায় ২১.০৫ সেন্টিমিটার পানি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দুপুর ১২টায় ২১.০৭ সে.মি বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পদ্মায় পানি বেড়েছে ১০ সেন্টিমিটার। তবে এখনো বিপদসীমার প্রায় ১.০৭ সেন্টি মিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে পুনর্ভবা নদীর পানিতে গোমস্তাপুর উপজেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত ইউনিয়নগুলো হচ্ছেÑ রহনপুর, আলিনগর, বাঙ্গাবাড়ী, বোয়ালিয়া, গোমস্তাপুর, চৌডালা ও রাধানগর।
পাঁচবিবি (জয়পুরহাট) : জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে উত্তরের ধেয়ে আসা পানি ও কয়েকদিনের টানা বর্ষণে উপজেলার পৌরসভাসহ ৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি গ্রাম প্লাবিত। গদাইপুর গ্রামের ১২শ মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন। আশ্রয় নিয়েছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কেউ ছাড়ছেন বাড়ি। বন্যায় তলিয়ে গেছে হাজার হাজার বিঘা রোপা আমনের ক্ষেত ও সবজির ক্ষেত। এদিকে দফায় দফায় ছোট যমুনার পানি বাড়ায় এখন হুমকির মুখে পড়েছে পাঁচবিবি-হিলি সড়ক ও নদী সংলঘœ পৌর ভবন। ভয়াবহ বন্যায় আতংকে রয়েছেন উপজেলাবাসী।
অপরদিকে ছোট যমুনার পানি বাড়ায় ধরঞ্জীর গদাইপুর গ্রাম প্লাবিত। নদীর দু-পাশ দিয়ে পানি ঢুকছে গ্রামে। পানি বন্দি হয়ে পড়েছে ১২শ মানুষ। সর্বস্বহারা এসব গৃহহীন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বিদ্যালয়গুলোতে। অনেকেই ছাড়ছেন গ্রাম। কেউ কেউ গরু, বাছুর, আসবাবপত্র আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে আশ্রয় নিয়েছেন পাশের গ্রামে। বন্যার্ত মানুষ ত্রাণের আশায় প্রতিনিদিন আশ্রয় কেন্দ্রে অপেক্ষা করছেন। এদিকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে বন্যার্তদের মাঝে ত্রান বিতরণ করা হয়েছে।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় প্রধান প্রধান নদীগুলোর পানি কমে গেলেও বন্যা সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তি রয়েছে। এছাড়া গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই উপজেলা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাবার সংকট ও গবাদি পশুর মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে এইসব এলাকার শত শত একর ফসলি জমি ও অসংখ্য ঘরবাড়ী ডুবে গেছে। এদিকে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাখালবুরুজ ইউনিয়নের নয়াবাজার বালুয়া এলাকায় বাঙ্গালী নদীর পানির তোড়ে নুরুল্যা বিল বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের প্রায় ১শ’ মিটার অংশ ভেঙ্গে গেছে। শনিবার সন্ধ্যায় বাঁধটি ভেঙ্গে গিয়ে পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এছাড়া গতকাল রোববার সকালের দিকে ঘাগট নদীর পানির প্রবল চাপে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডা-গাইবান্ধা সড়কের প্রায় ২০ ফিট অংশ ধসে যায়। ফলে এলাকার রেলপথ ও রেল সেতু হুমকির মুখে পড়েছে।
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) : চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মাদার্শা এলাকার আমতলীর পশ্চিম পার্শ্বে হালদা নদীর বেড়ি বাঁধ সাম্প্রতিক কালের প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ী ঢলে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তাছাড়া উক্ত এলাকায় বিগত একযুগে ৬৮ পরিবার নদী ভাঙ্গনে পূর্ব পুরুষের বসত ভিটা হারিয়েছে। এতে করে এলাকার ৭৫ কানি জমি ও ৫ টি পুকুর নদীতে তলিয়ে গেছে। বর্তমানে তিন বাড়ির ৩৪ পরিবার নদী ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ফুলজানা বাপের বাড়ি সৈয়দ হোসেন জানান,এ বাড়িতে এক সময় ৩৬ পরিবারের বসতী ছিল। বর্তমানে ১০ পরিবার নদী ভাঙ্গনের কারণে ভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছে।
স্থানীয় দৌলত বাড়ির আকতার হোসেন জানান, এ বাড়ির ৩ পরিবারের বসত ভিটা নদীতে তলিয়ে গেছে। বর্তমানে এ বাড়িতে যে ২৭ পরিবার রয়েছে তারাও নদী ভাঙ্গনের ঝুঁকির মধ্যে।
১৩ নং উত্তর মাদার্শা ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন চৌধুরী মাসুদ জানান,সাম্প্রতিক কালের প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট হালদা নদীর পাহাড়ী ঢলে আমতলী এলাকার পশ্চিম পাশে প্রায় আধা কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। যে বেড়ি বাঁধ একমাস পূর্বেও ছিল। বেড়ি বাঁধের ভাঙ্গনের কারণে এলাকার বাড়িঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢল ও বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে।
ইসলামপুর : ৮ দিন থাকি পানিত থাকতে থাকতে হাত পায়ে ঘা উঠি গেছে! গতকাল থাকি না খ্যায়া আছি, কথা গুলো এভাবেই প্রতিদিনের সংবাদ এর কাছে বলছিলেন ইসলামপুরের চিনাডুলী ইউনিয়নের বিলকিছ বেওয়া। চিনাডুলীর ষাট উর্দ্ধ বাসিরন বলেন, বাবা ক’দিন ধরে আমি অনাহারে অর্ধাহারে না খেয়ে আছি । হতদরিদ্র সন্তনরা কেউ আমার খোঁজ নেয় না। তার কথা শেষ না হতেই আকলিমা,পারভিন,তাসলিমা,মর্জিনা,চায়না,সুরুজ,বাবুল মিয়া, মেরাজুল, বুলবলি বলেন তাদের স্থানীয় চেয়ারম্যান দুর্দিনে পাশে এসে দাঁড়ায় সামান্য ত্রান নিয়ে। যমুনার পানি কমে গতকাল রোববার সকালে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে বিপদ সীমার ৫৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তাতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের তেমন কোন উন্নতি হয়নি। সারা জেলার বন্যা কবলিত, অসহায় অভাবী মানুষেরা রান্নার অভাবে খেতে পারচ্ছে না। তাদের দিন কাটছে অনাহারে অর্ধাহরে। এখন সর্ব ক্ষেত্রেই চলছে ত্রাণ ও চিকিৎসা সেবার জন্য হাহাকার ।
উপজেলা দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান জানান, বন্যার্তদের মাঝে বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে ১৯২ মেট্রিক টন চাল গতকাল শনিবার পযর্ন্ত ১৪৭ মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার ৪০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
নওগাঁ : বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে নওগাঁর আত্রাই নদীর পান্তি। তবে ছোট যমুনা নদীর পানি অপরিবর্তিত। পানি উন্নয় বোর্ডসূত্রে জানা গেছে, আত্রাই নদীর পানি কমে গিয়ে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ছোট যমুনা নদীর পানি অপরিবর্তিত বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে নওগাঁ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। নওগাঁয় ইকরতারা নামকস্থানে ছোট যমুনা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে সদর উপজেলার তিলকপুর, বোয়ালিয়া ইউনিয়ন, নওগাঁ পৌসভার পার-নওগাঁ, সুলতানপুর এলাকা, পার্শ্ববর্তী বগুড়া’র আদমদিঘী উপজেলার ছাতিয়ানগ্রাম, সান্তাহার এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। নওগাঁর জেলা প্রশাসক ড. মো. আমিনুর রহমান বলেন, জেলায় বন্যার্তদের ত্রান সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত জেলার ৯টি উপজেলায় ৩৪৭ মেট্রিকটন চাল এবং ১৫ লাখ ২২ হাজার নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
সোনাইমুড়ী (নোয়াখালী) : নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে বন্যা পরিস্থিতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বসতবাড়ী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সরকারী অফিস পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নোয়াখালী জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোঃ মাহবুব আলম তালুকাদরের ভাষায় এটা বন্যা নয়, মানবসৃষ্ট জলাবদ্ধতা। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নোয়াখালীতে কোন বন্যা নেই। অতি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
সাঘাটা (গাইবান্ধা) : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে যমুনা ও কাটাখালী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে এই উপজেলার প্রায় ৭৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে চরম দূর্ভোগ পোহাচ্ছে। কামালেরপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহিনুর ইসলাম সাজু জানান, টিংকরপুর আব্দুর রহমানের বাড়ী সহ কয়েকটি বাড়ী নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম এবং চাকুলী, বাঙ্গাবাড়ী, যালালতাইড়, ফলিয়া, বলিয়ার বেড়, গজারিয়া, নশিরারপাড়া, আগ ও পাছ গড়গড়িয়া, মোংলার পাড়া, কৈচড়া গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়াও জুমারবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রোস্তম আলী জানান, ব্যাঙ্গারপাড়া, থৈকরেরপাড়া, পূর্ব-আমদিরপাড়া, কাঠুর, চান্দপাড়া, পূর্ব বসন্তেরপাড়া, পূর্ব জুমারবাড়ী, কামারপাড়া, বাজিতনগর, ম্যাছট, চরপাড়া, বগারভিটা, দহিচড়া গ্রামের প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বোনারপাড়া ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান ওয়ারেছ আলী জানান, দলদলিয়া, আগ ও পাছ বাটী, মধ্য শিমুলতাইড়, রাঘবপুর, ভুতমারা, তেলিয়ান, সাহারভিটা সহ প্রায় ৫ হাজার মানুষ পনিবন্দী হয়ে চরম দূর্ভোগে পড়েছে। কচুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমান জানান, ত্রিমোহনী, অনন্তপুর, রামনগর, গাছাবাড়ী, পশ্চিম কচুয়া, চন্দনপাঠ, সতীতলা গ্রামের প্রায় ৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুমার ঘোষ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিঠুন কুন্ডু সার্বক্ষণিক বন্যা কবলিত এলাকায় পরিদর্শণ ও ত্রাণ বিতরণ করে চলেছেন বলে জানান।
"