মো. ইমাম হোসেন জমাদ্দার, পিরোজপুর
হুমকির মুখে কুড়িয়ানার ঐতিহ্যবাহী পেয়ারা চাষ
‘বাংলা আপেল’ খ্যাত পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার দেড় শ বছরের পেয়ারার চাষ এখন হুমকির মুখে। মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব, যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পেয়ারাচাষিদের এ সমস্যা পোহাচ্ছে প্রতি বছর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় দেড় শ বছর আগে থেকে এই এলাকা পেয়ারা চাষের জন্য বিখ্যাত। শ্রাবণ মাস পেয়ারার ভর মৌসুম। পেয়ারাকে ভালোবেসে ‘বাংলার আপেল’ আবার কেউ ‘গরিবের আপেল’ হিসেবে গণ্য করে। সুমিষ্ট এই পেয়ারা শুধু কুড়িয়ানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ হচ্ছে। উন্নত যোগাযোগ আর হিমাগারের অভাবে যুগ যুগ ধরে ন্যায্য মূল্য আর মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চাষিরা।
স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারার চাষ এখন পার্শ^বর্তী ঝালকাঠি, বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ৫০ গ্রামে চাষ হচ্ছে। তবে বিশেষ করে আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়ন, সমুদয়কাঠি ও জলাবাড়ীসহ তিন ইউনিয়নে ১ হাজার ৩৪৫টি পরিবার পেয়ারা চাষ দ্বারা যুগ যুগ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এ উপজেলার কাঠ ব্যবসার পরেই মৌসুমভিত্তিক এই পেয়ারা চাষ অর্থনীতির একমাত্র উৎস বলে সর্বজন স্বীকৃত। স্বরূপকাঠির সংগীতকাঠি, খায়েরকাঠি, ভদ্রানন্দ, বাস্তুকাঠি, ভাঙ্গুরা, আদাবাড়ী, বাহ্মণনকাঠি, ধলাহার, জিন্দাকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, ইদলকাঠি, মাদ্রা, বেঙ্গুলি, আদমকাঠি, অশ্বত্থকাঠি, সেহাংগল ও আন্দারকুলসহ ২৬ গ্রাম নিয়ে রয়েছে বিস্তৃত এ পেয়ারার চাষ। যা প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ হাজার মেট্রিক টন বিক্রীত পেয়ারা থেকে ৮-৯ কোটি টাকা উপার্জিত হচ্ছে বলে চাষিরা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। যে পেয়ারা প্রতি মণ আষাঢ়ে বিক্রি হয় ৪৫০-৫০০ টাকা। শ্রাবণ শেষে তা নিচে নেমে মূল্য দাঁড়ায় মাত্র ৩০-৪০ টাকা মণ দরে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, স্বরূপকাঠি উপজেলায় ৬৪৫ হেক্টর জমির পেয়ারাবাগানের মধ্যে আটঘর কুড়িয়ানাতেই ৫২২ হেক্টর জমির পেয়ারাবাগান রয়েছে। যার প্রতি হেক্টর জমিতে ৮-৯ টন পেয়ারা ফলে। উপজেলায় ২ হাজার ৫৫টি পেয়ারাবাগান রয়েছে।
এ বছর চাষিদের ফলন ভালো হলেও পেয়ারায় এনথ্রাকনোস নামক এক প্রকার ভাইরাস যা, স্থানীয় ভাষায় (পেয়ারার সিট) পড়া রোগ বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এতে করে ঝরে পড়ছে বাগানের অধিকাংশ পেয়ারা। পেয়ারা সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরনসহ সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রতি বছর মৌসুম শেষে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের।
স্থানীয় পেয়ারা চাষি মোঃ মোস্তফা কামাল জানান, তার কয়েকটি বড় বড় পেয়ারার বাগান রয়েছে। আষাঢ়ের প্রথমে সে প্রতি মণ পেয়ারা বিক্রি করেছে ৪৫০-৫০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু শ্রাবণের শেষ সময়ে থেকে এই পেয়ারা মণপ্রতি দাম দাঁড়ায় ৩০-৪০ টাকা দরে। ৩ জন পেয়ারা পাড়ার শ্রমিককে রোজ দিতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা করে। সব মিলিয়ে ওই সময়ে প্রতিদিনই লোকসানের শিকার হতে হয়। এভাবে শুধু মোস্তফা নয় আরো শত শত চাষিকে সিজনের সময় বিপাকে পরতে হয়।
উপজেলার কুড়িয়ানার ইউপি চেয়ারম্যান শেখর কুমার সিকদার বলেন, এলাকার অর্ধশত গ্রামের চাষিরা যুগ যুগ ধরে এ ফলের চাষ করে আসছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প নির্মিত না হওয়ায় ও পাশাপাশি লাভের চেয়ে উৎপাদন খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিরা পেয়ারা চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
এ ব্যাপারে বিসিক কর্মকর্তা মোঃ হারুন অর রশিদ বলেন, উদ্যোক্তা ও পরিকল্পিত ভাবে তা বাস্তবায়নে সম্ভব হলে একটি হিমাগার ও জ্যাম-জেলি প্রস্তুত কারখানা স্থাপন করা সম্ভব।
স্বরূপকাঠি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ রিফাত সিকদার জানান, সরকার স্বরূপাঠিতে দুটি কৃষিপণ্য বিপণন কেন্দ্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী বছরই এর কাজ শুরু হবে বলে তিনি আশা করেন। এর ফলে কৃষকেরা একদিকে তাদের অতিরিক্ত ফসল সংগ্রহ করতে পারবে; অন্যদিকে পেয়ারার মৌসুম ছাড়াও অধিক মূল্যে পেয়ারা বিক্রি করতে পারবে।
"