গাজী মো. শাহাদত হোসেন ফিরোজী, সিরাজগঞ্জ

  ০২ এপ্রিল, ২০২০

উত্তরাঞ্চলের নদীনির্ভর ১৮ লাখ মানুষের জীবনে দুর্দিন

জলবায়ু পরিবর্তন এবং উজানে পানি সরিয়ে নেওয়ার ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদ-নদী, শাখা ও উপ-নদীগুলো মরা খালে পরিণত হয়েছে। সিরাজগঞ্জের কিছু অঞ্চলসহ প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ নাব্য সংকটে নৌযান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে এ অঞ্চলের নদীনির্ভর প্রায় ১৮ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এছাড়া এসব অঞ্চলের সেচ কার্যক্রমও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

জানা গেছে, উজানে ভারত ফারাক্কা ও গজলডোবা ব্যারেজের সাহায্যে নদীর প্রবাহ আটকে সেচ ক্যানালের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় শতাধিক প্রধান, শাখা ও প্রশাখা নদী নাব্যতা হারিয়ে নৌযান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুম আসতে না আসতেই অসংখ্য পানির প্রাকৃতিক উৎস শুকিয়ে গেছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে আর্সেনিকের মাত্রা। এ অঞ্চলের যেসব নদ-নদী একসময় মানুষের বাঁচার অবলম্বন ছিল তা এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়ার প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ। এখন তা সড়কপথ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

উত্তরাঞ্চলের একসময়ের খরস্রোতা পদ্মা, মহানন্দা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, বড়াল, নন্দকুজা, ভদ্রাবতী, সরস্বতী, ইছামতি, সুতিখালি, গুমানী, আত্রাই, গুড়নদী, করতোয়া, ফুলঝোর, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, ঝরঝরিয়া, কাকন, মুক্তাহার, কাকেশ্বরী, সুতিখালি, গোহালা, গাড়াদহ, স্বতী, ভেটেশ্বর, ধরলা, দুধকুমার, সানিয়াজান, তিস্তা, ঘাঘট, ছোট যমুনা, নীলকুমার, বাঙ্গালী, বড়াই, মানস, কুমলাই, সোনাভরা, হলহলিয়া, জিঞ্জিরাম, বুড়িতিস্তা, যমুনেশ্বরী, মহানন্দা, টাঙ্গান, কুমারী, রতœাই, পূনর্ভবা, ত্রিমোহনী, তালমা, ঢেপা, কুরুম, কুলফি, বালাম, ভেরসা, ঘোড়ামারা, মালদহ, চারালকাটা, পিছলাসহ শতাধিক প্রধান নদী, শাখা ও প্রশাখা নদীর প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ নাব্যতা হারিয়ে নৌযান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, একসময় উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীতে স্টিমার, লঞ্চ ও বড় বড় মালবাহী নৌকা চলাচল করত। এর বাইরেও নদী পারাপারের জন্য খেয়া নৌকা ছিল। খেয়াঘাটের ইজারাদার এবং মাঝিরা যাত্রী পারাপার করে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতেন। শুধু খেয়া নৌকা নয়, এ অঞ্চলের মানুষ অনেক আগে ‘গয়না নৌকায়’ চড়ে দূর-দূরান্তের হাটবাজারে যাতায়াত করতেন। ভোররাতে

বিভিন্ন গ্রাম থেকে গয়না নৌকা যাত্রী নিয়ে শহর-বন্দরের উদ্দেশে রওনা হতো। আবার সময় অনুযায়ী কোনোটা বিকালে আবার কোনোটা রাতে যাত্রী নিয়ে ফিরে যেত গ্রামে। এ অঞ্চলের প্রায় ১৬ লাখ জেলে নদ-নদীতে মাছ ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতেন। তারা এলাকায় মাছের চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায় মাছ সরবরাহ করতেন। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় নৌকার মাঝিমাল্লা ও জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। নৌকার মাঝিমাল্লা ও জেলেদের মতো বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন স্টিমার ও লঞ্চের সারেং, সুকানি, লস্কর, মাস্টার আর কেরানি। অনেকেই বাধ্য হয়ে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।

বিআইডব্লিউটিএর আরিচা অফিস সূত্রে জানা যায়, পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, বড়াল, হুড়াসাগর, করতোয়াসহ প্রধান প্রধান নদীর বুক চিরে এক সময় লঞ্চ-স্টিমার চলাচল করত। গোয়ালন্দ থেকে ভারতের বিহারের পাটনা পর্যন্ত যে স্টিমার চলাচল করত সেটা বাজিতপুর হয়ে যেত। অপর দিকে যমুনা নদী বেয়ে বেড়ার নগরবাড়ী, ভারেঙ্গা, নাকালিয়া, স্থলচর, সিরাজগঞ্জ ও কালীগঞ্জ হয়ে আসাম প্রদেশে চলে যেত। এই সার্ভিস ছিল নিয়মিত। বাজিতপুর ঘাট থেকে পশ্চিম বাংলার দীঘা পর্যন্ত স্টিমার যাতায়াত করত। ঈশ্বরদী সাঁড়াঘাট ও কুষ্টিয়ার মধ্যে যাতায়াতকারী স্টিমার সার্ভিস ছিল নিয়মিত। ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ, ঢাকা-নগড়বাড়ী-রাজশাহী, বেড়া-বড়াল ব্রিজ রুটসহ এ অঞ্চলে অসংখ্য রুটে লঞ্চ চলাচল করত। লঞ্চ চলাচল করতে ৯ থেকে ১০ ফুট পানির গভীরতা প্রয়োজন হয়। এ অঞ্চলের নদীগুলোতে পানির প্রয়োজনীয় গভীরতা নেই। তাই লঞ্চ চলাচল করতে পারে না। লঞ্চ মালিকরা অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। যারা নৌকা চালিয়ে জীবন ধারণ করতেন তারা অন্য পেশায় গিয়ে সুবিধা করতে পারছেন না। এ দিকে উত্তরাঞ্চলে জেলেদের চলছে চরম দুর্দিন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদী বিশেষজ্ঞ কামরুন নেছা জানান, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনাসহ ৫৪টি আন্তর্জাতিক বা আন্তদেশীয় নদী বর্ষা মৌসুমে ভাটি অঞ্চলে পলি বয়ে আনে। গড়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর উজান থেকে সাধারণ বা পরিমিত বৃষ্টিপাতের ফলে পলি আসে প্রায় ১৪০ কোটি টন। প্রকৃতপক্ষে পলি আসার সঠিক বা বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো উপাত্ত কারো কাছে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পলি জমার পরিমাণ নিরূপণ করা প্রয়োজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের গঙ্গা ব্যারাজ (পরিত্যক্ত) প্রকল্পের সাবেক পিডি কবিবুর রহমান জানান, বাংলাদেশের উজানে অবস্থিত পানির উৎসগুলোর প্রায় সবগুলোতেই ভারত বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব নদ-নদীর মূল উৎস প্রধানত হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত। কিছু আছে অন্য পাহাড়ে। এসব মূল নদী ও উপনদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এর বিরূপ প্রভাবে দেশের নদীপথ ও পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের নৌ যোগাযোগ ও সেচ কার্যক্রম মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close