প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

শহীদ মিনার নেই অধিকাংশ বিদ্যালয়ে সরকারি বরাদ্দ না থাকার অজুহাত

৬৮ বছর আগের ভাষা আন্দালনের পথ ধরে স্বাধীনতা ৪৯ বছর পেরিয়েছে দেশে। এরপরও দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষাশহিদদের স্মরণে তৈরি করা হয়নি শহীদ মিনার। এ অবস্থা জেলা শহর থেকে শুরু করে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজগুলোতে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি ছাড়া কোনো মাদরাসায় নেই শহীদ মিনার। এতে যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পলন করতে পারে শিক্ষার্থীরা।

বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানায়, অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাঁশ, কাঠ, ককসিট দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় তারা। শহিদদের স্মরণে প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি তাদের।

প্রশাসন বলছে সরকারি বরাদ্দের কথা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার তৈরির জন্য সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ নেই। এ ছাড়া নির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি যে, শহীদ মিনার করতেই হবে, তাই নিজ উদ্যোগে প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার তৈরি করতে হচ্ছে তাদের।

মানিকগঞ্জ থেকে আজিজুল হাকিম, ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল থেকে খুরশিদ আলম শাওন, পটুয়াখালীর বাউফল থেকে দেলোয়ার হোসেন, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থেকে মওদুদ আহম্মেদ, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান থেকে নাজমুল মোল্লা, বরগুনা বেতাগী থেকে নিজাম উদ্দীন স্বাধীন, আমতলী থেকে সাঈদ খোকন, তালতলী থেকে মল্লিক মো. জামালের পাঠান খবর :

মানিকগঞ্জ : জেলা প্রশসন অফিস সূত্রে জানা যায়, মানিকগঞ্জে জেলায় মোট ৬৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ১২৯টি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার আছে, বাকি ৫২১টি বিদ্যালয়ে নেই। এদিকে ২২৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৯টি মাধ্যমিক, ২৬টি মাদরারাসা ও ৬টি কলেজে নেই শহীদ মিনার। আছে বাকি ১৪৭টি বিদ্যালয়ে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নিলুফা রহমান জানান, বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার তৈরির জন্য সরকারিভাবে কোন বরাদ্ধ নাই। যেহেতু সরকারি কোন নির্দেশনা নাই এবং নির্দিষ্টভাবে বলা হয় নি যে শহীদ মিনার করতেই হবে তাই নিজ উদ্যোগে প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার তৈরি করতে হবে তাদের।

জেলা শিক্ষা অফিসার মো. ফরিদুল ইসলাম জানান, জেলায় শহীদ মিনার না থাকা বিদ্যালয়ের বিষয়ে অধিদফতরকে অবহিত করব। সরকারি নির্দেশনার কথা স্বীকার করে তিনি আরো বলেন, শহীদ মিনার নির্মাণে যাদের অক্ষমতা আছে, আলোচনা করে তাদেরকে শহীদ নির্মাণ করতে বলা হবে।

রাণীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও) : উপজেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১৫৬টি সরকারি প্রাথমিক, ৫২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১২টি কলেজ ও ১৯টি মাদরাসা আছে। এ ছাড়া রয়েছে অর্ধশতাধিক কিন্ডারগার্টেন।

সপ্তাহব্যাপী ঘুরে দেখা যায়, মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বুদ্বিজীবি স্মৃতিস্তম্ভ ছাড়া ১৫৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনটিতেও নেই শহীদ মিনার। এছাড়া ৩৭টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৯টি কলেজে নেই শহীদ মিনার। এদিকে মাদরাসার কোনো এর বালাই নেই। একই অবস্থা কিন্ডারগার্ডেনগুলোর।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোকছেদুর রহমান বলেন, সরকারিভাবে বরাদ্দ হলে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার স্থাপন করা হবে। একই মন্তব্য করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আলী শাহরিয়ার। জানতে চাইলে ইউএনও মৌসুমী আফরিদা বলেন, সরকারিভাবে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার করা হবে কিনা সে বিষয়ে আমার জানা নেই। আপনারা এ ব্যাপারে শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বাউফল (পটুয়াখালী) : পটুয়াখালীর বাউফলে উপজেলায় ২৩৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এরমধ্যে মাত্র ১৬টি বিদ্যালয়ে রয়েছে শহীদ মিনার। বাকি ২১৯ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই কোন শহীদ মিনার। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সরকারি অর্থবরাদ্দ না থাকার কথা উল্লেখ করে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রিয়াজুল হক বলেন, শীঘ্রই সরকারিভাবে শহীদ মিনার নির্মানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এদিকে ইউএনও জাকির হোসেন বলেন, প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাতে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়, সেই বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত পূর্বক অচিরেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আক্কেলপুর (জয়পুরহাট) : জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে মোট ১০৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৯টি, মাধ্যমিক ২০টি, মাদরাসা ১০টি ও কলেজ ৭টি। এর মধ্যে মাত্র ৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার আছে। সেই সঙ্গে উপজেলায় যে সকল নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কিন্ডার গার্ডেন স্কুল রয়েছে তাদের নেই কোন শহীদ মিনার। কোন সরকারি ও জাতীয় অনুষ্ঠানে তাদের অংশ গ্রহন চোখে পড়ে না।

আক্কেলপুর ইউএনও মো. জাকিউল ইসলাম জানান, শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে শহীদ মিনারহীন প্রতিষ্ঠানের তালিকা নিয়ে মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা করা হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সিরাজদিখান (মুন্সীগঞ্জ) : মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার ৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাঁশ ও ককসিটসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রুদ্ধা নিবেদন করে আসছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১২৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে শহীদ মিনার রয়েছে মাত্র ৩৫টিতে।

প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘শহীদ মিনার তৈরির জন্য আমরা সব সময় স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করে আসছি। বর্তমানে স্থানীয়দের সহযোগীতায় অনেক শহীদ মিনার হচ্ছে। আশা করছি পর্যায় ক্রমে সব স্কুলে শহীদ মিনার হবে।’

বেতাগী (বরগুনা) : স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও বরগুনারস বেতাগী উপজেলায় দেড়শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার। প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১৩৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৫টি মাধ্যমিক, ২১টি মাদরাসা, নিম্ন মাধ্যমিক ও ১০টি কলেজ মিলিয়ে মোট ১৯২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৪০টিতে শহীদ মিনার রয়েছে।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহিদুর রহমান জানান, স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অস্থায়ী বেদি তৈরি করে শহীদ দিবস পালন করে। আগামীতে পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে।’ প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. জাহাঙ্গির আলম জানান, ‘শহিদ মিনার করার জন্য আমাদের কোন বাজেট নেই। তবে এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’ ইউএনও মো. রাজিব আহসান বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের মধ্যেই আমরা ধীরে ধীরে শহীন মিনার করার ব্যবস্থা নিব।’

আমতলী-তালতলী (বরগুনা) : বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মিত হয়নি শহীদ মিনার। উপজেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানাগেছে, আমতলী ও তালতলী উপজেলায় ৩২৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমতলী উপজেলায় ১৫২টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৩টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২৬টি মাদরাসা ও ৫টি কলেজ রয়েছে। অপর দিকে তালতলী উপজেলায় ৭৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১২টি দাখিল মাদরাসা ও ১টি কলেজে রয়েছে। এর মধ্যে আমতলীতে ১৯টি বিদ্যালয় ও ২টি কলেজ এবং তালতলীতে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১টি কলেজে শহীদ মিনার রয়েছে। এ দুই উপজেলার কোন মাদরাসায় শহীদ মিনার নেই।

আমতলী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘উপজেলার ৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে শহীদ মিনার নির্মিত হলেও বাকী বিদ্যালয়গুলো এখনো সম্ভব হয়নি হয়নি। পর্যায়ক্রমে অবশিষ্ট সব বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে।’

এদিকে তালতলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার লুৎফর কবির কামরুল আহ্সান মুঠোফোনে বলেন,‘উপজেলার ১১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য স্থায়ী শহীদ মিনার আছে।’ তিনি স্বীকার করেন, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা প্রয়োজন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close