আতিকুর রহমান আজাদ, কালকিনি (মাদারীপুর)

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

কালকিনিতে ১৫ কমিউনিটি ক্লিনিক

ভবন নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে অনিয়মের অভিযোগ

তিনটি ইউনিয়নের ভবনের কাজ বন্ধ করে দিল এলাকাবাসী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্প কমিউনিটি ক্লিনিক। মাদারীপুরের কালকিনিতে এ কমিউনিটি ক্লিনিকের একটি ভবন নির্মাণ কাজে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকৌশীর যোগসাজশে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনটি ভবনের কাজ বন্ধ রয়েছে। বন্ধ কমিউনিটি ক্লিনিক ৩টি হলো দক্ষিণ দক্ষিণ ভাউতলী কমিউনিটি ক্লিনিক, পূর্ব আলীপুর কমিউনিটি ক্লিনিক ও লক্ষীপুর বিদ্যাবাগিস কউমিনিটি ক্লিনিক। নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও কাজের ওয়ার্ক অর্ডারের কপি পাবেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তারা কোন কপি পাননি।

জানা গেছে, সিডিউল অনুযায়ী কমিউনিটি ক্লিনিকের নতুন মডেলের প্রতিটি ভবনে চারটি রুম থাকবে, দুটিতে সেবাদানকারীরা বসবেন, একটি রোগীদের ওয়েটিং রুম আর একটি লেবার (ডেলিভারি) রুম হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বাথরুম থাকবে দুটি। একটি হাই কমোড, একটি নরমাল কমোড, ফ্লোর ও ওয়াল পুরোটাই টাইলস ফিটিং থাকবে, জানালায় থাইগ্লাস, পানির ট্যাংকি, পানি ওঠানোর জন্য মটর থাকবে। এছাড়া গভীর নলকূপ ও ফার্নিচার থাকবে আধুনিক মানের। কিন্তু আধুনিকতার ছোয়া কথা থাকলেও বাস্তব চিত্রে এর কিছুই পাওয়া যায়নি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তদারকি প্রতিষ্ঠানের যোগসাযোসের মাধ্যমে ভবনগুলো হস্তান্তরের চেষ্টা করছে।

উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের সূর্যমনি কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ শেষ হয়েছে গোজামিল দিয়ে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটির কাজ সমাপ্ত করে বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। সেগুলোর কাজের মানও খুব খারাপ। বাশঁগাড়ী আউলিয়ারচর কমিউনিটি ক্লিনিকের ঢালাইয়ের কাজে নি¤œমানের ইট, বালু ও খোয়ার ব্যবহার করার কারণে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল এলাকাবাসী। দক্ষিণ ভাউতলী কমিউনিটি ক্লিনিকের ছাদ ঢালাইয়ের পর চারপাশের ইট গাথার প্রায় ১ বছর হলেও ঠিকাদার আর কোন কাজ করেনি। অপরদিকে পূর্ব এনায়েতনগরের পূর্ব আলীপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ করে গত ৮ মে তার পর থেকে কাজ বন্ধ রয়েছে। লক্ষীপুর ইউনিয়নের বিদ্যাবাগিস কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজও বন্ধ প্রায় ১ বছর ধরে। তারপর থেকে আর কোন কাজ করা হয়নি। এ পাঁচটি ছাড়াও বাকি আরও ১০টি কাজে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

লক্ষ্মীপুরের সূর্যমনি কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রাক্কলিত মূল্য ২২ লাখ চুরানব্বই হাজার ৫৪৬ টাকা, দক্ষিণ ভাউতলী কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রাক্কলিত মূল্য ২৬ লাখ ৬৫ হাজার ৩১০ টাকা, পূর্ব এনায়েতনগর কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রাক্কলিত মূল্য ২৬ লাখ ১৬ হাজার ৯১৪ টাকা ও আউলিয়ারচর কমিউনিটি কিøনিকের প্রাক্কলিত মূল্য ২৭ লাখ ৪৯ হাজার ৭৮৮ টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সূর্যমনি কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ শেষ হয়েছে। তবে গভীর নলকূপ থেকে পানি ওঠে না। কাজের মান ভালো না হওয়ায় এলাকাবাসী কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। কাজের ব্যাপারে সূর্যমনি এলাকার বাসিন্দা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মো. ইকবাল হোসেন সরদার বলেন, কাজের মান অত্যান্ত নিম্নমানের। ছাদের পুরান রড দেওয়া হয়েছে। ঢালাইয়ে নি¤œমানের খোয়া ও বালুর সঙ্গে কম মাত্রায় সিমেন্ট দেওয়া হয়েছে। ফার্নিচার মানও খারাপ। এছাড়া ফিটিংসও ভালো দেওয়া হয় নাই। কাজের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলে ঠিকাদারের লোকজন বলেন, ‘আমরা গোপালগঞ্জের শেখ পরিবারের লোক, বেশি ঝামেলা করলে চাঁদাবাজীর মামলার দিয়ে দেবো।’

এ ব্যাপারে কমিউনিটি ক্লিনিকের সভাপতি মো. মোদাচ্ছের হোসেন বলেন, ‘কাজের মান খুবই খারাপ, দায়সারা ভাবে কাজ করে গেছেন ঠিকাদার। এখন কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কাগজে সাক্ষর দিতে বলে। কাজের ব্যাপারে বেশি খোঁজ খবর নিতে গেলে চাঁদাবাজী মামলার হুমকি দেয়। আবার বলে আমরা শেখ পরিবারের লোক। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কাজ করে গেছে।’

অভিযুক্ত ঠিকাদার মো. শিপন বলেন, ‘ভাই আগে জানলে এই কাজ নিতাম না। কাজে আমার লাভ হয় নাই। সূর্যমনি এলাকার মানুষ ভাল না। আমি এত ভাল কাজ করলাম তারও আমাকে তারা মারছে। আবার আমার কাছে চাঁদা চায়।’

এদিকে আউলিয়াচর কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজের মান ভালো নয় বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। এই ভবনের কাজের দেখভাল করেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার জাকিয়া সুলতানা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক এলাকাবাসী বলেন, ক্লিনিকের কাজ খারাপ হওয়ার ব্যপারে আমরা কিছু বলতে গেলে ঠিকাদার বা তার লোকজন বলে, আপনাদের এত খবর রাখার দরকার নাই। আউলিয়ারচর কমিউনিটি ক্লিনিকের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান সুমনকে তার ব্যবহৃত মোবাইলে একধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

অভিযুক্ত ঠিকাদার ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘আমি মূল ঠিকাদার না, আমি কাজ কিনে করছি।’ এ ব্যাপারে এসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জাকিয়া সুলতানার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধীকবার যোগাযোগ করার চেষ্ঠা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আল বিধান মোহাম্মদ সানাউল্লাহ বলেন, ‘কাজগুলো মূলত স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে করা হয়। কাজ শেষে এলাকার বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, সিএইচসিপি এবং কমিউনিটি গ্রুপের সদস্যরা কাজের মানের ব্যাপারে সরাসরি আমার কাছে অভিযোগ জানান। আমি স্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরকে বিষয়টি অবহিত করি। কিন্তু উল্টো বিভিন্ন প্রশ্ন ও ক্ষোভের সম্মুখীন হই। তবে নির্মাণ কাজের ব্যাপারে কোন দায়ভার আমি নিব না।’

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগের জেলা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল হান্নান শেখে বলেন, কোন কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজের কি কি ত্রুটি আছে ও কোনটি কোনটি বন্ধ আছে আমাকে বলেন। কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ বন্ধের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাই আমরা পারি ঠিকাদারকে চিঠি লিখতে ও জরিমানা করতে। আর কী করতে পারি? তবে ঠিকাদার কাজ করবে। কাজের মান ভালো না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি শুনেছি কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ ভালো হয়েছে। আপনি যদি দুই-তিন মাস আগের করা বলেন তা কি হবে। আপনি বর্তমানের কথা বলেন।’

এ ব্যাপারে ইউএনও মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজের কোন কাগজপত্র পাইনি। পেলে তদন্ত করে দেখবো। আর কাজের মান ভালো না হলে কাজ বন্ধ করে দেব।’ উপজেলা চেয়ারম্যান মীর গোলাম ফারুক বলেন, ‘১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ চলছে আমি জানি না। কাজের কোন ধরনের কাগজপত্র আমি পাইনি।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close