সালাহ্উদ্দিন শুভ, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার)

  ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

জনবল ও চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত বন্যপ্রাণী রক্ষণাবেক্ষণ

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারটির ভবনগুলোর চারদিকে ঝোপ-জঙ্গলে আচ্ছাদিত হয়ে রয়েছে।

জনবল ও চিকিৎসক সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া বন ক্যাম্প এলাকায় অবস্থিত ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টারটি। রেসকিউ সেন্টারে বন্যপ্রাণী থাকলেও তাদের চিকিৎসা প্রদানের জন্য নেই কোন চিকিৎসক। প্রাণীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চিকিৎসকসহ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৪-৫ জন লোকের প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে ২ জন দিয়েই চলছে এর কার্যক্রম। এতে ব্যাহত হচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার হওয়া প্রাণীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, লাউয়াছড়া বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি ভ্রমণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের প্রায় ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ, সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালের ৭ জুলাই জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই বনে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ বন্যপ্রাণী ও গাছপালা। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরিসাপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি রয়েছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশে অবশিষ্ট অঞ্চলের চিরহরিৎ বর্ষাবন বা রেইন ফরেষ্টের মত, এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।

কমলগঞ্জের লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করার পর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের আওতাধীন এই বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বনের জানকিছড়া ক্যাম্পের ভিতরে তৈরি করা হয় ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার। রেসকিউ সেন্টারটি তারের বেড়া দ্বারা আবদ্ধ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেন্টারটির ভবনগুলোর চারদিকে ঝোঁপ-জঙ্গলে আচ্ছাদিত হয়ে রয়েছে। দেখলে মনে হবে যেন অনেকদিন ধরে কারো পদচারণা ঘটেনি এখানে। অনেকটাই ভূতরে অবস্থা। শুধুমাত্র প্রাণীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৪-৫ জন লোকের প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে ২জন দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে দায়সারা ভাবে। তারমধ্যে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জুনিয়র ওয়াউল্ড লাইফ স্কাউট ও অন্যজন বনপ্রহরী।

সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জুনিয়র ওয়াউল্ড লাইফ স্কাউট ঋষু বড়ুয়া সেখানে থাকা বন্যপ্রাণীদের দেখভাল করেন। তবে তার অবর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকেন তার সহকারি বনপ্রহরী মো. ইব্রাহিম। বন প্রহরীর বিষয়ে দক্ষতা থাকলেও এখানে রাখা প্রাণীগুলোর খাবার বন্টন ও দেখভাল সম্পর্কে সেরকম কোন দক্ষতা নেই ইব্রাহিমের। অপরিস্কার-অপরিচ্ছন্নতার মধ্যেই রেসকিউ সেন্টারটিতে বর্তমানে বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার হওয়া ২টি মেছোবাঘ, ৫টি বানর ও ছোট-বড় ৩টি বার্মিজ অজগর সাপ রয়েছে। সেন্টারটিতে মূলত আক্রান্ত-অসুস্থ প্রাণীকে উদ্ধার করে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলার পর সেগুলোকে আবার বনের নিরাপদ স্থানে অবমুক্ত করার কথা। তবে প্রাণী চিকিৎসক না থাকায় গুরুতর আক্রান্ত প্রাণীর ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এ কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষকদের। এক্ষেত্রে তারা পার্শ্ববর্তী শ্রীমঙ্গল পশুসম্পদ চিকিৎসা কেন্দ্রের সহায়তা নেওয়া হয়। গত ৩বছর ধরে চিকিৎসক ছাড়াই চলছে এই রেসকিউ সেন্টারটি।

শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেব বলেন, ‘সরকারী অর্থায়নে জানকিছড়া ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার ও সেবা কেন্দ্র করলে করলেও এখানে নেই কোন চিকিৎসক। তাছাড়া পর্যাপ্ত লোকবলও নেই। বাধ্য হয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ তাদের বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে আহত বন্যপ্রাণী পাঠায়। তখন এসব আহত বন্যপ্রাণীদের সেবা দিয়ে সুস্থ্য করে ফেরৎ দিলে আবার সেগুলিকে জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হয়।’

এ বিষয়ে লাউয়াছড়া বনবিটের রেঞ্জার মোনায়েম হোসেন বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে রেসকিউ সেন্টারটির কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘ ৩ বছর ধরে চিকিৎসক না থাকায় আহত অবস্থায় কোন বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে আনলে তা পার্শ্ববর্তী পশুসম্পদ চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয়। নতুবা বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে দিয়ে দেওয়া হয়, তারাই সুস্থ করে তোলে। তবে জনবল সংকট নিরসনের জন্য উচ্চ পর্যায়ে সুপারিশ করা হয়েছে। জনবল নিয়োগ দিলেই পুনরায় প্রাণ ফিরে পাবে সেন্টারটি।’

কমলগঞ্জ জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সম্পাদক মো. আহাদ মিয়া বলেন, ‘বণ্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য লাঊয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অনেক প্রাণী খাদ্যের জন্য লোকালয়ে গেলে স্থানীয়দের হাতে এমনকি মাঝে মধ্যে শিকারিদের হাতে আটকা পড়ে। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে এ সেন্টার নির্মাণ করা হলেও দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, উদ্ধার হওয়া আহত প্রাণীগুলোর চিকিৎসার জন্য নেই কোন পশু চিকিৎসক। বন্যপ্রাণীর স্বার্থে যত দ্রুত সম্ভব লাউয়াছড়া রেসকিউ সেন্টারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল ও চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close