আদিল হোসেন তপু, ভোলা

  ২৪ জুন, ২০১৯

মনপুরায় কালকিনি বিটের বন উজাড় করে দখল হচ্ছে জমি

উপকূলীয় জেলা ভোলার সাগর মোহনার কালকিনি বিটের বন উজাড় করে দখল হচ্ছে জমি। চর নিজাম ও চর আনোয়ারা নিয়ে গঠিত উপকূলীয় বন বিভাগের কালকিনি বিট। গত ১৫ জুন, শনিবার ভোলার মনপুরা উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একদল ‘ভূমিদস্যু’ চর নিজামে জমি দখল করতে গেছে। এ বিষয়ে বন বিভাগ পুলিশ-প্রশাসনের সাহায্য চেয়েও পায়নি। দখলদারদের দাবি, মনপুরা উপজেলা ভূমি অফিস তাদের ৬০০ ভূমিহীনকে বনের জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে। তাই দখলে গেছেন তারা।

ভোলা উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ফরিদ মিয়া বলেন, চর নিজাম বনের কোনো জমি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ডি-রিজার্ভ করেনি। আর ভূমি অফিসকেও বন বিভাগ কোনো জমি বুঝিয়ে দেয়নি। তাই ওই বনের জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তারপরেও যদি ভূমি অফিস বনের জমি বন্দোবস্ত দিয়ে থাকে তা বন বিভাগ মানবে না।

কালকিনি বিটের বন সংরক্ষক (বিট অফিসার) এস এম আমির হামজা বলেন, চর নিজাম বনের পরিমান বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার ২৪০ একর। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার একর বন দখল হয়েছে। গত ২ বছরেই (২০১৭-১৯ অর্থ বছর) দখল হয়েছে প্রায় ৩০০ একর বন। এ ছাড়া গত ১৫ জুন মনপুরা উপজেলার ভাইস-চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান রাশেদ মোল্লার নেতৃত্বে শতাধিক লোক এসে বনের জমি মাফজোখ করে কয়েকশ’ একর ভাগাভাগি করে পিলার পুঁতেছে। তাঁদের নিষেধ করা সত্ত্বেও শোনেননি। ইতিপূর্বেও তারা জমি দখল করেছে।

বিট অফিসার আরও বলেন, এসব জমিতে কয়েক বছর আগেও বনায়ন ছিল। বন উজাড় করে কাঠ নিয়ে যায় ইটভাটায়। জমি ফাঁকা করে আবার জমি দখল করছে।

বাঁধা দেননি কেনো প্রশ্ন করলে বিট অফিসার আক্ষেপ করে বলেন, তাঁদের কথা কেউ শোনে না। লোকবল কম। অস্ত্র বলতে শুধু লাঠি। একজন বন প্রহরী। পুলিশ-প্রশাসনকে বললেও তারা ব্যবস্থা নেন না। অথচ কালকিনি বিটের বন, সাগর মোহনা ও আইন-শৃংখলা রক্ষায় একটি অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে। যা বন রক্ষায় কোনো কাজে আসছে না। নিরবে দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা করা ছাড়া তাদের কোনো কাজ নেই। গত ৮ বছরে তারা ১৪টি মামলা দিয়েছেন। এসব মামলা করলেও হামলা হয়। গত দুই বছরে তিন দফায় বিট কার্যালয়ে হামলা হয়েছে। সব আসবাব ভেঙে ফেলেছে।

জানতে চাইলে উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান রাশেদ মোল্লা বলেন, ভোলার সব জমির মালিক ডিসি (জেলা প্রশাসক)। সেই ডিসি, ইউএনও, এ্যসিল্যান্ড স্বাক্ষর দিয়ে ২০০৪-০৫ সালে ভূমিহীনদের জমি বন্দোবস্ত দিলেও তারা জমি বুঝে পায়নি। বন বিভাগ প্রতিনিয়ত বাঁধা দিয়ে আসছে। সেই জমির দখল বুঝে নিতে তারা চরে এসেছেন। বনের জমি দখলে নয়।

উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যানের সঙে থাকা কার্ডধারী ইউসুফ বলেন, তাঁদের কবুলতনামা, খাজনা-দাখিলাসহ সকল কাগজ আছে। কিন্তু জমি দখলে নেই। তারা জমির দখল নিতে এসেছেন।

মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফোরকান হোসেন বলেন, বন দখলের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

মনপুরা ইউনিয়নের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বশির আহমেদ বলেন, তিনি শুনেছেন ভাইস-চেয়ারম্যান বন্দোবস্ত পাওয়া জমি মাপজোখ করতে গেছেন।

সরেজমিন ঘুরে, চরবাসির সঙ্গে কথা বলে ও দুই পক্ষের সকল কাগজপত্র ঘেটে দেখা যায়, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ভোলার কয়েক লাখ মানুষ মারা যাবার পরে সরকার উপকূলীয় অঞ্চলে বনায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৬ সালে সরকার সাগর মোহনায় জেগে ওঠা ১২ লাখ ৩০ হাজার একর চরভূমি (কাঁচা চর) বন বিভাগকে (অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের ভিত্তিতে) হস্তান্তর করে ম্যানগ্রোভ (শ্বাসমূলীয়) বনায়নের জন্য। নিয়ম হচ্ছে, বনের কোনো জমি চাষযোগ্য হলে বন বিভাগ পুনরায় ভূমি অফিসকে তা ফিরিয়ে দেবে। যা খাস জমি হিসাবে গন্য হবে। তবে চর নিজামের কোনো জমি বন বিভাগ ছাড়েনি। নথিপত্রে আরও দেখা যায়, বন বিভাগ ১৯৭৮ সালে সাগর মোহনার চর নিজামে বনায়ন শুরু করে। যে বনে বর্তমানে কয়েকশ’ হরিণসহ কয়েক রকম বন্য প্রাণি রয়েছে।

দেখা যায়, বনে ম্যানগ্রোভ বনায়ন ছাড়া কিছু কাঠ, নারকেল-সুপারীর গাছ রয়েছে। মাটিতে পলি মাটির চেয়ে বালির পরিমাণ বেশি। এখনও উচ্চ জোয়ারে বন প্লাবিত হয়। সবজির আবাদ তেমন একটা নেই। লোকজন বন উজাড় করে পুকুর কেটে উঁচু করে বাড়ি করেছে। ত্রাণ বিভাগ বনের মধ্যে ইট বিছিয়ে রাস্তা ও বন কেটে গুচ্ছগ্রাম-আশ্রয়ন প্রকল্প করছে। বেসরকারি হিসাবে চরে প্রায় ৭ শতাধিক পরিবারের বাস। ভাঙন কবলিত অসহায় মানুষ, তারা সবাই জেলে। এসব মানুষ জীবনের প্রয়োজনে বনের জমি থেকে গাছ সংগ্রহ করে নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ সারছে। অভিযোগ আছে বনপ্রহরীরা এ জন্য চরবাসীর কাছ থেকে নগদ সুবিধা নিচ্ছে। যদিও বন বিভাগ তা অস্বীকার করেছে।

আরও জানা যায়, ভূমি অফিস দুই দফায় ৬৭০টি কার্ডে এক হাজার ১৭০ একর জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে। ক্ষমতাসীনরাও চরে লোকজনকে বসাচ্ছেন। চরবাসীর অভিযোগ, ভূমি অফিস ও ক্ষমতাসীরা যে সব লোককে বনের জমিতে বসাচ্ছেন বা বন্দোবস্ত দিচ্ছেন তাদের মাত্র ১৩৫ জন চরে বসত করছে। বাকিরা চরে নয়, মনপুরা উপজেলা সদরে বসবাস করে। যাদের অনেকে কোটিপতি।

ভোলা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কিংবা বন বিভাগ কাগজে-কলমে ভূমি অফিসকে চর নিজামের কোনো কৃষি জমি বুঝিয়ে দেয়নি। বন বিভাগের মৌখিক অনুমতিতে ১৯৮৩-৮৪ অর্থ বছর ও ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে ভূমি অফিস চর নিজাম বনের কিছু জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে। পরে যখন দেখা গেল বন বিভাগ জমি হস্তান্তর করেনি তখন বন্দোবস্ত বাতিল করেছে। এ অবস্থায় যদি কেউ বন বিভাগের জমি দখল করতে যায় সেক্ষেত্রে প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।

ডিসি আরও বলেন, ভবিষ্যতে বন বিভাগ ভূমি কার্যালয়কে জমি হস্তান্তর করলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বন্দোবস্ত দেবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close