মারুফ আহমেদ, কুমিল্লা

  ১১ এপ্রিল, ২০১৯

কয়েক শ বছরের ‘বলি নারায়ণ’ দিঘি ভরাট করে ভবন

কুমিল্লায় কোনভাবেই পুকুর বা দীঘি ভরাট বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন প্রভাবখাটিয়ে নিয়মিত পুকুর ভরাট করছে প্রভাবশালীরা। ইতোমধ্যে একে একে হারিয়ে গেছে শহরের ঝাউতলা, বাদুরতলা, বাগিঁচাগাও, অশোকতলা, গুধুরপুকুর, চর্থার জিনার পুকুর, রাজগঞ্জ পান পট্টি, প্রফেসরপাড়া, নতুন চৌধুরীপাড়া, ঠাকুরপাড়া, মোগলটুলী, চকবাজার বাস টার্মিনাল সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার অনেক পুকুর বা দীঘি। সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে আদর্শ সদর উপজেলার কয়েকশ বছরের পুরনো ‘বলি নারায়ণ’ নামক বিশাল দীঘিটি। রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রভাবশালীরা দীঘি ভরাট করে বেচাকেনার পাশাপাশি ভবন নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে। তবে এটা প্রতিরোধে বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সদর উপজেলার দূর্গাপুর উত্তর ইউনিয়নের দুর্গাপুর এলাকায় প্রায় ১০ একর আয়তনের বিশাল দিঘিটির নাম ‘বলি নারায়ণ’। সুপ্রাচীনকাল থেকে দূর্গাপুরের ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরাতন ট্রাঙ্ক রোডের পাশে বিশাল দিঘির কারণে এলাকাটি ‘দীঘিরপাড়’ হিসেবে পরিচিত। শত শত বছর ধরে এই এলাকার পানীয় জলসহ গৃহস্থালীর পানির বড় উৎস হিসেবে হাজারো মানুষের নিত্য প্রয়োজন মিটিয়ে আসছে।

দীঘিটি সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য জানা না গেলেও স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা ও ভূমি অফিস সূত্র জানায়, নারায়ণ নামের এক সনাতন ধর্মাবলম্বী জমিদার প্রজাদের পানি সমস্যা সমাধানে প্রায় পাঁচশ বছর আগে দিঘীটি খনন করে ছিলেন। হিন্দু অধ্যূষিত এই এলাকার লোকজন বিভিন্ন পূজা, পার্বনসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠান দিঘির পাড়েই সম্পন্ন করতেন। দেবতাকে উৎসর্গ করে পাঁঠা বলি হতো দিঘির পশ্চিম পাড়ে। সেখান থেকেই এর নাম ‘বলি নারায়ণ’ হয় বলে অনেকের অভিমত।

স্থানীয় হান্নান, হুমায়ুনসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, দীঘিটির কোন সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও তারা বংশ পরম্পরায় জেনে এসেছেন বিগত ৫-৬ পুরুষ ধরে এই এলাকার পানির প্রধান ও একমাত্র উৎস দীঘিটি। তারা আক্ষেপ করে বলেন, বর্তমানে দীঘিটির উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে বাসাবাড়ি এবং দক্ষিণ পাড় এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ চলছে পুরোদমে। জলাশয়, পুকুর বা দীঘি ভরাটে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মানছে না কেউ। এদিকে জেলা প্রশাসন থেকে পুকুর ভরাট বন্ধ বা শ্রেণি পরিবর্তনে নিষেধাজ্ঞার পরও থেমে নেই নির্মাণ কাজ। স্থানীয়রা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ জেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগেও তা রোধ করতে পারছেন না।

স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, জেলা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সরেজমিন এসে গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে মাটি ভরাট বন্ধে স্থানীয় তহসিল অফিসকে নির্দেশনা দেয়। এর প্রেক্ষিতে গত তিন মাস ভবন নির্মাণ বা মাটি ভরাট বন্ধ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি আবারো দিঘির উত্তর পাড়ে ভবন নির্মাণ করছে একটি চক্র।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দিঘির চারপাশে অবৈধ স্থাপনা করার ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সত্যতা পেয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দিঘির চারপাশ ঘিরে থাকা আলেকজান মেমোরিয়াল স্কুল এন্ড কলেজসহ ৫ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আলেকজান স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ, দীঘির মালিকানা দাবীদার আলমগীর হোসেন, খোকন মিয়া, শাহ আলম ও ইয়াকুব আলীকে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছিল। এরপর অজ্ঞাত কারণে নিরব হয়ে যায় পরিবেশ অধিদপ্তর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সূত্র জানায়, বর্তমানে জেলা প্রশাসন দিঘিটি রক্ষায় সরব হলেও অজ্ঞাত কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর নিরব রয়েছে। বর্তমানে ৪১ জন ব্যক্তি দিঘিটির মালিকনা দাবি করে বিভিন্ন জায়গা দখল নিচ্ছেন ও বিক্রি করে দিচ্ছেন। তারপর নতুন ক্রেতারা আবার দিঘি ভরাট করে ভবন নির্মাণ করছেন। এ কাজে প্রভাশালী বিক্রেতারা সহযোগীতা করায় সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে কোন প্রতিবাদ করছেন না।

সূত্র জানায়, দিঘিতে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়দের ব্যবহারের পাশাপাশি মাছ চাষ হতো। বর্তমানে দিঘি মাছ শূন্য। এরই মাঝে দীঘিটির উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ের অনেকটাই অংশ মালিকানা বদল হয়ে গেছে। দক্ষিণ পাড়ে আলেকজান মেমোরিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের ভবন নির্মাণ সহ সব পাড়েই চলছে ভরাটসহ ভবন নির্মানের উৎসব।

জেলার অন্যতম বৃহৎ দিঘি ভরাটের বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামসুল আলম এই প্রতিবেদক বলেন, ‘আমার কি আর কোন কাজ নাই, শুধু দিঘি নিয়ে বসে থাকা ছাড়া? আপনারা যখন তখন ফোন করেন!’ জানতে চাইলে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর বলেন, ‘দিঘি ভরাট বন্ধে জেলা প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নিবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close