নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বইপ্রেমী মকবুল হোসেন

রাজনীতির ময়দান থেকে বইয়ের রাজ

আহমদ ছফার ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরান’ উপন্যাসের নায়ক তুখোড় রাজনীতি ছেড়েও জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছিল চিলেকোঠার আঙিনায় পাখিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে। তেমনই জীবনের নায়ক মকবুল হোসেন। ইতিহাসের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলের জেলা নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেসব ছেড়ে জীবনের নিভৃত ঐশ্বর্য গড়েছে নিজের গড়া পাঠাগার আর কবিতা চর্চায়। জাতীয় জীবনে পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়ার চর্চা যখন উঠেই গেছে, সেই সময় রাজধানী থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরের দিনাজপুর শহরে বাতিঘরের মতো জ্বলে আছে ১০ হাজারের অধিক বইয়ের সেঁওতি পাঠাগার।

শহরের সরদারপাড়া এলাকার দুইতলা বাড়ির ছাদের অর্ধেকটা জুড়ে ঘর। ঘরের দেয়াল ঢাকা পড়েছে সেলফে। প্রতিটি তাকে থরে থরে সাজান বই। সাহিত্য থেকে নৃ-তত্ত্ব, ইতিহাস থেকে অর্থনীতি, ধর্মগ্রন্থ থেকে দর্শন, শিশু সাহিত্য থেকে বিদেশি সাহিত্যে ঠাসা। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব অনেক বই হারিয়েও গেছে। সেলফ ছাড়িয়ে দীর্ঘ টেবিলে জমেছে নতুন-পুরনো বইয়ের ভার। এখানেই প্রতি মাসে জমে সাহিত্য আড্ডা, প্রকাশ হয় দ্বিমাসিক পত্রিকা সেঁওতি। ছাদের বাকি অংশজুড়ে কবুতরের বাসা ও ফুলের বাগান। এসব নিয়েই কাটে একাত্তরের রণাঙ্গনের যোদ্ধা মকবুল হোসেনের সময়। দেয়ালে ঝুলছে পেন্সিল ও কলমের স্কেচ, ঘরে কোণে দাঁড়ান কাঠ খোদাইয়ের কাজ তারই করা।

একাত্তর পূর্ব সময়ে আদর্শভিত্তিক সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন মকবুল হোসেন। ১৯৭০ সালে জেলা ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বানিীতে সক্রিয় ছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রথম কাউন্সিলে ছাত্রলীগের জেলার সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। নেতৃত্বের ধারায় ১৯৭৪ সালে দিনাজপুর আইন কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জিএস নির্বাচিত হন তিনি। ৭৫-এর ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকা-ের পর দেশজুড়ে দিনাজপুর শহরে যেসব আওয়ামী লীগে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছিলেন এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন মকবুল হোসেন। তবে জেল থেকে ফিরে আর আওয়ামী লীগের যোগ দেননি। তার ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধুর লাশ রেখে যে সংগঠনের নেতারা মোস্তাকের গভর্মেন্টে যোগ দিতে পারে, সেখানে আমি যোগ দিতে পারি না।’

তবে ৮০-র দশকের শুরুতে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের পর জাতীয় পার্টির নেতা হিসেবে রাজনৈতিক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চেয়েছিলেন তিনি। সে সময়ের রাজনৈতিক একাধিক শিষ্য এখন জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ নেতা। দেখা হলে এখনো তাকে গুরুতুল্য শ্রদ্ধা করেন। তার একসময়ের রাজনৈতিক সহকর্মীরা জানান, মকবুল হোসেনের গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব ও গুণাবলির কারণে বরাবরই রাজনৈতিক দলগুলো তাকে সাদরে টেনেছে। তবে আদর্শ চর্চার কারণে শেষ পর্যন্ত দলীয় সব সংশ্রব থেকে নিজেকে বিযুক্ত করেছেন। দিনাজপুর-৫ আসনের এমপি মুস্তাফিজুর রহমান ফিজার বলেন, ‘কে কোন রাজনৈতিক আদর্শ করবেন, এটা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। তবে তিনি একজন ভালো মানুষ, ভালো সংগঠক ছিলেন। তবে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়ার তার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়।’

শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই বিচিত্র পাঠের উজ্জ্বল নেশা তাড়িত হন মকবুল হোসেন। বইপড়া ও সংগ্রহের জন্য শহরের সব বইয়ের দোকানে পরিচিত মুখ তিনি। রাজনীতির প্রয়োজনে কোথাও গেলেও, প্রয়োজনীয় বই খুঁজে সংগ্রহের নেশা তার বাদ পড়েনি। তবে বয়সের ভারে চলাচল সীমিত হয়ে এসেছে তার। শহরের জজ কোর্ট এলাকার গোটা দশেক পুরনো বই বিক্রেতারাই এখন প্রধান উৎস। এই বই বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন স্থান থেকে পুরনো বইয়ের লট এলে প্রথমেই মকবুল হোসেনকে খবর দেন তারা। তিনি পছন্দের বই সংগ্রহ করার পর বিক্রির জন্য উপস্থাপন করেন। এমনকি সঙ্গে পর্যাপ্ত টাকা না থাকলেও তাকে বই দিতে বারন নেই। এভাবেই ৩০ বছর ধরে বই সংগ্রহ করেছেন তিনি।

দিনাপুরের মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চবিদ্যালয়ে থেকে মকবুল হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু। পার্শ্ববর্তী জেলা ঠাকুগাঁওয়ের বিডি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। সে সময় কলেজের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। সেদিনের সেøাগান ও বক্তৃতা পারদর্শী মকবুল হোসেন এখন কথা বলেন নরম স্বরে। মাথার ঝাকড়া চুল ঝরে গিয়ে এখন বিরল কেশ তার। অতীত সমর্থন করে মুখে ছেয়ে গেছে সফেদ দাড়িতে। বয়সের ভারে থির থির করে কাঁপে শরীর। বইপড়া শুরু নিয়ে মকবুল হোসেন জানান, শৈশবে তার বিস্তর সময় কেটেছে দিনাজপুরের কালীতলায় অবস্থিত শতবর্ষী আর্য পাঠগারে। এখানেই শৈশবে তার সঙ্গে দেখা হয়ে ছিল দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবের (জেসি দেব) সঙ্গে।

প্রয়াত খলিল উদ্দিন ও মর্জিনা বেগনের ১১ সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ মকবুল হোসেন বড় ভাই চিত্রশিল্পী তোজাম্মেল হোসেনের অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে আসেন। একইভাবে তাকে অনুসরণ করে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন অনুজরা। তার দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে বাবার অনুসরণে এগিয়ে আছেন মেয়ে আইনজীবী ও নারী অধিকার কর্মী মৌসুমী ফেরদৌসী। বাবার সম্পর্কে বলেন, ছোটবেলা থেকেই বাবার বই সংগ্রহ দেখে বড় হয়েছি, পরে বইপড়ায় আমরাও উদ্বুদ্ধ হয়েছি।’ অনুযোগ নয়, বাবাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এমনকি আমার একমাত্র মেয়ে শুভেচ্ছা ইসলাম নানার প্রভাবে পড়–য়া হয়েছে।’ দুই বছর আগে স্ত্রী প্রয়াণের পর লাইব্রেরিই বাবার বৈরাগ্য দুনিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান ছেলে মুনতাসির মিনার।

স্থানীয় ও আঞ্চলিক প্রকাশনায় নিয়মিতই প্রকাশ হয় মকবুল হোসেনের কবিতা ও গদ্য। লেখার আনন্দে প্রকাশ করা হয়নি কোনো বই। প্রায় প্রতিদিনই সেঁওতি পাঠাগারে পা পড়ে গবেষক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও সাহিত্য প্রেমীদের। স্বরচিত কবিতা পাঠ ও আলোচনায় মুখর মাসিক সাহিত্য আড্ডাগুলোর মধ্যমণি থাকেন মকবুল হোসেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এমনি এক আড্ডায় উপস্থিত হয়ে ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অভ্র বসু ও অধ্যাপক শ্রীলা বসু।

সাহিত্য পত্রিকা সেঁওতির সম্পাদনা করেন আড্ডার সঞ্চালক দিনাজপুর সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক গবেষক ড. মাসুদুল হক। তিনি বলেন, ৯০ দশকের শেষের দিকে রাজনীতি বিমুখ হয়ে লাইব্রেরিতেই মগ্ন হয়েছেন তিনি। আগে শহরে নানা বিষয়ে আড্ডা হতো, পরে সেঁওতি পাঠাগারে নিয়মিত আড্ডা দিতে শুরু করি। ব্যক্তিগত হলেও পাঠাগারটি জেলার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আগামী বছর মকবুল হোসেন কবিতা নিয়ে বই করার পরিকল্পনা জানান তিনি।

স্থানীয় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে বইপ্রেমী মকবুল হোসেনকে প্রথমবারের মতো পুরস্কৃত করে দিনাজপুর জেলা পরিষদ। ভবিষ্যতে বই সংরক্ষণ সম্পর্কে মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমার পরের প্রজন্মই রক্ষা করবে সেঁওতি পাঠাগার। সে হিসেবেই গড়ে তুলেছি তাদের। আর যদি না পারে ট্রাস্ট করে লাইব্রেরি করবে।’ পাঠাগারটি আধুনিকায়নের পর পাঠক ও গবেষকদের অবারিত করার ইচ্ছে আছে তার।

এ বিষয়ে দেশের বেসরকারি পাঠাগার রক্ষাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ঢাকা অফিসে যোগাযোগ করা হলে পাঠাগারকে প্রথমের তাদের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত করার পরামর্শ দেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close