নূর মো. শাওন, লামা (বান্দরবান)

  ১২ জানুয়ারি, ২০১৯

পাহাড়ের ফাঁকে, নদীর পাড়ে তামাকের ভয়াল বিস্তার

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামায় প্রতিবছর ব্যাপক হারে বাড়ছে কৃষি জমিতে তামাক চাষ। এ জন্য মাটিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, বিষ ব্যবহার করায় হ্রাস পাচ্ছে উর্বর ক্ষমতা। জেলার রবিশস্য ফলনে আশংকাজনক এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

চলতি মৌসুমে এ লামা পৌরসভাসহ ৭টি ইউনিয়নে প্রায় ৫ হাজার একর কৃষি জমিতে তামাক চাষ শুরু করেছে বিভিন্ন তামাক কোম্পানীর রেজিস্টার্ডকৃত চাষীরা। এছাড়াও রেজিস্ট্রেশন বহির্ভূত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ভুঁইফোড় ট্যোবাকো কোম্পানী মিলে আরো প্রায় ১ হাজার একর কৃষি জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে বলে বিভিন্ন টোব্যাকো কোম্পানির মাঠকর্মীদের কাছ থেকে জানা যায়।

সরোজমিনে দেখা গেছে, নিয়মনীতি না মেনে উপজেলার মাতামুহুরী নদীর বুক ও দুই পাড়ে তামাক চাষ করছেন বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানীর চাষিরা। বেশি ফলনের আশায় গত তিদশক ধরেই কৃষি জমিতে অতিরিক্ত ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে আসছেন তারা।

ট্যোবাকো কোম্পানির তথ্য ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি একর জমিতে ৭৫ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু অধিক ফলনের আশায় কৃষকরা জমিতে এ হারের দ্বিগুণ ইউরিয়া সার প্রয়োগ করছেন। এতে উপজেলার কৃষি জমির উর্বরা শক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া তামাক চাষ শেষ হওয়ার পরপরই জমিতে ‘সবুজ সার’ প্রয়োগের নিয়ম থাকলেও কেউ তা পালন করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে একাধিক কৃষক প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, তামাক কোম্পানীগুলো সবুজ সার প্রয়োগের বিষয়ে স্থানীয় কৃষকদেরকে কোন ধরণের উৎসাহ দিচ্ছে না। নামে মাত্র স্বল্প মাত্রায় এলাকার কৃষকদের মাঝে ধৈঞ্চা বীজ বিলি করে আসছে তারা। তা বাস্তবে আদৌ প্রয়োগ করা হয়েছে কিনা তথ্য নির্ভর সূত্রে জানা যায়নি।

লামা উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, লামা উপজেলার অধিকাংশ মাটি বেলে-দোঁআশ থেকে এটেল-দোঁআশ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রাচীনকাল থেকে এই মাটি পাহাড় ধসে, জৈব-রসায়নিক প্রক্রিয়া ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এবং নানাবিধ খনিজ পদার্থের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে। মাটির রং ঘন বাদামী থেকে হলুদাভ-বাদামী। মাটির পিএইচ ৪.৫ থেকে ৬.০ পর্যন্ত। উপজেলায় মাটির ১১টি সনাক্তকৃত শ্রেণির মধ্যে কাপ্তাই এটেল-দোঁআশ সর্বাধিক। যা এলাকার আবাদি জমির প্রায় ৬৫% মাটির নির্দেশক।

কৃষিজমিগুলিতে অসম মাত্রায় অথবা শুধু ইউরিয়া সারের উদ্বেগজনক প্রয়োগ, বিষাক্ত ও নিষিদ্ধ বালাইনাশকের এলাপাথাড়ি ও অযাচিত ব্যবহার, গোবর ও জৈব সারের পরিমাণ কম এবং সীমিত পরিমাণটুকুও অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সর্বোপরি মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় কৃষকের জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব প্রকট। কৃষি ভিত্তিক জরীপে এখন মাটির উর্বরা শক্তির এই আশংকাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। এর পরেও প্রতিবছর তামাক চাষে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হচ্ছে। ফলে অচিরেই এ অঞ্চলের মাটির উর্বরা শক্তি হারিয়ে কৃষি জমিগুলি মৃতপ্রায় মাটিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষি ও পরিবেশবিদরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পাহাড়ের ফাঁকে এবং বন বিভাগ ও লামা থানার ফসলি জমি, নদী, ছড়া-ঝিরি তীরবর্তী যেসব সমতল কৃষি ভূমি রয়েছে, বর্তমানে এসব এলাকার ৮০ ভাগ, কোন কোন স্থানে ৯০ ভাগ জমির মধ্যেই তামাক চাষে দখল নিয়েছে।

কৃষক মো. আব্দুল মতিন, আ. ছালাম পুতু, মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, খুব সহজে তামাক কোম্পানী থেকে তামাকের ঋণ পাওয়া যায়। তাছাড়া তামাক বিক্রয়ের নিশ্চয়তাদেয় কোম্পানিগুলো। অন্য দিকে, রবিশষ্যের ঋণ সহজে পাওয়া যায় না, কৃষি ফসলাদি বিক্রয়ের কোন নিশ্চয়তাও নেই। তাই আমরা তামাক চাষে ঝুঁকেছি।

লামা কৃষি কর্মকর্তা নূরে আলম জানান, আমরা কৃষকদের মাঝে সব সময় সভা সেমিনারের মাধ্যমে তামাকে ক্ষতিকারক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করি এবং তামাক চাষের চেয়ে রবি শষ্য চাষাবাদ করার জন্য আহ্বান করি। তাছাড়া সরকার থেকে প্রদত্ত নানা প্রকার রবিশষ্যের প্রণোদনা দিয়ে কৃষককে সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে থাকি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close