রাকিবুল ইসলাম রাকিব, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ)

  ১৫ অক্টোবর, ২০১৮

বিলুপ্তির পথে কয়লাচালিত ইস্ত্রি

গৌরীপুরে কয়লা জ্বেলে জীবন চালায় ‘সালমান’

খানিকটা বড়সড় পিতলের ইস্ত্রি। ইস্ত্রির ভেতর জ্বলন্ত লাল কয়লা। কয়লার আগুনে গরম হচ্ছে ইস্ত্রি। আর ওই গরম ইস্ত্রি দিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করা হচ্ছে। এক সময়কার স্থানীয় ধোপাবাড়ির সাধারণ চিত্র ছিলো এটি। কিন্তু বিদ্যুৎ আর প্রযুক্তির এই ডিজিটাল যুগে কয়লার ইস্ত্রি এখন বিরল। তবে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মাওহা ইউনিয়নের মাওহা বাজারে গত মঙ্গলবার বিকালে এমন এক দৃশ্য ধরা পড়লো। রাস্তার পাশে টেবিল রেখে এক কিশোর ছেলে কয়লাচালিত ইস্ত্রি দিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করছে।

কাছে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সে প্রতিনিধিকে জানায়, তার নাম আশরাফুল আলম সালমান (১৩)। সে মাওহা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মাওহা গ্রামেই তাদের বাড়ি। তার বাবার নাম-আকবর আলী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সালমান সবার ছোট। অভাব-অনটনের কারণে পড়াশোনার খরচ দিতে পারতো না পরিবার। তাই নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে দুই বছর ধরে এই কাজ করছে।

কথা বলতে বলতেই কাপড় ইস্ত্রি করছিলো সালমান। ইস্ত্রির ফাঁকা অংশগুলো দিয়ে দেখা যাচ্ছে গনগনে লাল জ্বলন্ত কয়লা। কুচকে যাওয়া কাপড়কে আবার টানটান করে তার স্বরূফে ফিরিয়ে আনতেই ইস্ত্রি করা হয়। কয়লা যখন পুড়তে পুড়তে সাদা ছাইয়ে পরিণত হয়, তখন ইস্ত্রির হাতলের নিচে ঢাকনা খুলে আবার নতুন করে কয়লা দেয়া হয়।

সালমান জানায়, ইস্ত্রিতে একবার কয়লা ভরে আগুন জ্বেলে দিলে ঘণ্টা খানেকর মতো সময় নির্বিঘেœ চলে। এই সময়ে ১০-১২ টি কাপড় ইস্ত্রি করা যায়। এখানে কয়লাও কেনা যায় অল্প টাকায়। ফলে খরচও কম।

নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে দুই বছর ধরে এই কাজ করছে সে। শুধু তাই নয় নিজের আয়ের টাকা থেকে সে বোনের পড়াশোনার খরচেও টুকটাক সহযোগিতা করে। এরই মধ্যে বিকালের গড়িয়ে সন্ধা নামার সঙ্গে সঙ্গে মাওহা বাজারে অন্ধাকার নেমে আসছে একটু একটু করে। এমন সময় বাজারের ব্যাগ হাতে উপস্থিত হলেন সালমানের বাবা আকবর আলী। কিন্তু তখনো বাজারের টাকা যোগাড় করতে পারেনি সালমান। তাই বৃদ্ধ বাবা ও ছেলে গ্রাহকের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এ প্রতিনিধির সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। গল্পের এক ফাঁকে আকবর আলী বলেন, ‘সংগ্রামের কয়েক বৎসর পরে তেইশ্য টেকা দিয়া কয়লার এই ইসতারিডা কিইন্যা আনি। তহন তো গেরামে কারেন্ট আছিলো না। হেইসময়ে আমার লন্ড্রির ব্যবসাডাও ভালা ছিলো। পরে কারেন্টের ইসতারি আওনের পরে কয়লার ইসতারির চল কইম্যা যায়।’

প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘এহন আর কয়লার ইসতারি (ইস্ত্রি) পাইবেন কই? এসব এখন আর নাই। কারেন্ট আহনের আগে তো এগুলো দিয়াই কাপড় ডলতো সবাই।’

প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার মাওহা বাজারে এবং শুক্র ও সোমবার ভুটিয়ারকোণা বাজারে রাস্তার পাশে টেবিল বসিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করেন সালমান। প্রতিটি কাপড় ইস্ত্রি করতে ৫ টাকা করে নেয় সে। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাপড় ইস্ত্রি করে করে তার আয় হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মতো।

গল্পের ফাঁকে বড় হয়ে কি হতে চাও জানতে চাইলে সালমান বলেন, ‘কয়লার আগুন জ্বেলেই এখন জীবন চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করতে চাই। জীবিকার তাগিদে হয়তো এখন এই কাজ করছি। কিন্তু যখন চাকরি করবো তখন আর আমাকে ইস্ত্রি নিয়ে রাস্তায় দাড়াতে হবে না।’

এরই মধ্যে গ্রামের এক বাসিন্দা চলে এসেছে পড়নের পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করতে। তাই কথা শেষ না করেই কাপড় ইস্ত্রিতে মন দিলো সালামান। পিতলের ওপর বসানো কাঠের হাতল ধরে এক মনে কাপড় ইস্ত্রি করে যাচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধাকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথীবির সময়ও যেন একটু পেছনে চলে এসেছে এখানে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close