জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট

  ১৬ আগস্ট, ২০১৮

৮ শিক্ষার্থীকে পাস করাতে বার্ষিক ব্যয় ৩৪ লাখ টাকা

এক শিক্ষার্থীর জন্য তিনজন শিক্ষক!

ইবতেদায়ি শাখার প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী মাত্র একজন। তবে এই একজন শিক্ষার্থীর জন্য সরকারি বেতনভুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা তিনজন। এ অবস্থা লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের মোস্তফি ভুড়িধোয়া দাখিল মাদ্রাসার।

অবহেলিত গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়াতে স্থানীয়দের উদ্যোগে ১৯৯০ সালে মোস্তফি ভুড়িধোয়া দাখিল মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি পেলেও পরে দাখিল পর্যন্ত অনুমোদন দেন মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। এরপর ২০০০ সালের এপ্রিলে ইবতেদায়ি শাখায় তিনজন শিক্ষক ও দাখিল শাখায় ১৪ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, এমপিওভুক্তির পর শিক্ষকরা পাঠদানে অবহেলা শুরু করলে শিক্ষার্থীরাও মাদ্রাসা ছেড়ে যেতে শুরু করে। একবার সরকারি বেতনভুক্ত হলে আর কখনোই বাদ যায় নাÑ এই ধারণা থেকে শিক্ষকরাও ইচ্ছেমতো আসতে শুরু করেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও দেখভালের অভাবে শিক্ষার পরিবেশ হারিয়ে ফেলেছে মাদ্রাসাটি।

সরেজমিনে মাদ্রাসা ঘুরে দেখা গেছে, কাগজ-কলমে ১০টি শ্রেণিতে ২২৮জন শিক্ষার্থী থাকলেও বাস্তবে ৪০ জন শিক্ষার্থীও খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থী বা শ্রেণি কক্ষ নেই। পুরো ইবতেদায়ি শাখায় পঞ্চম শ্রেণিতে রয়েছে একমাত্র শিক্ষার্থী নাঈম মিয়া।

মাদ্রাসাটিতে পড়ালেখার কোনো পরিবেশ নেই। পাশের বেঞ্চে খেলা করছে দুটি মুরগি। সেখাই নাঈমকে পাঠদান করছেন জুনিয়ার মৌলভী আক্কাস আলী। তার নিজেরও কোনো প্রস্তুতি নেই।

মাদ্রাসায় সংবাদকর্মীরা এসেছেন শুনে ভোঁ দৌড়ে ছুটে এসে নাঈম মিয়াকে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করেন শিক্ষক আক্কাস আলী। পাশেই মুরগি খেলা করছে সেটাও ভুলে গেছেন তিনি। শিক্ষক আক্কাস আলী বলেন, প্রতিদিন পাঁচ-সাতজন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। তবে অজ্ঞাত কারণে আজ অন্যরা অনুপস্থিত। অন্যসব শ্রেণি কক্ষ কোথায় জানতে চাইলে পাশের সাইকেল রাখা ফাঁকা কক্ষটি দেখান তিনি।

তবে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে পাঁচ থেকে আটজন করে শিক্ষার্থী বসে রয়েছেন শিক্ষক আসার অপেক্ষায়। কোনো ক্লাসে শিক্ষক গেলেও প্রস্তুতিহীন। সংবাদকর্মীদের আগমনে পুরো প্রতিষ্ঠান যেন আতঙ্কিত। শিক্ষক হাজিরা খাতায় ছুটি নেই, স্বাক্ষর দেওয়ার ঘরটিও ফাঁকা। তবুও প্রতি মাসে বেতন আসে তাদের নামে। এটা দেখে যে কেউ মনে করবেন প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকে এখানে কোনোদিন সরকারি দফতরের কেউ পরিদর্শন করেননি। অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানান, কয়েক মাস পরেই জেডিসি পরীক্ষা অথচ তাদের ইংরেজি বিষয়ে দুই অধ্যায়ও পড়ানো হয়নি। সংবাদকর্মীরা এসেছেন শুনে শরীর চর্চার শিক্ষক নূর ইসলাম মিয়া এসেছেন ইংরেজি ক্লাসে। তাদের কোনো ক্লাসরুটিন নেই। যেদিন যখন ইচ্ছে শিক্ষকরা ক্লাসে আসেন। প্রতিদিন দুপুরেই মাদ্রাসা ছুটি হয়ে যায়।

মাদ্রাসার অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১০টি শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ২২৮ জন। শিক্ষক-কর্মচারী মিলে ১৭ জনের বেতন বাবদ প্রতি মাসে সরকারি বরাদ্ধ ২ লাখ ৮৫ হাজার ২২২ টাকা। গত দাখিল পরীক্ষায় ২৮ জন অংশ নিলেও পাস করেছে দুইজন। সেটাও আবার বিগত বছরের দুই শিক্ষার্থী। জেডিসি পরীক্ষায় ৩৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিগত বছরের তিনজনসহ পাস করে মাত্র ১৬ জন। মাত্র সাত-আটজন শিক্ষার্থীকে পাস করাতে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বাবদ সরকারি খরচ বছরে ৩৪ লাখ ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা ও দুটি উৎসব ভাতা।

পাশের গ্রামের মোড়ল আজিজার রহমান বলেন, শিক্ষকরা ক্লাস না করায় ছেলে মেয়েরা মাদ্রাসায় গিয়ে গল্পগুজব করে বাড়ি ফিরে যায়। শিক্ষকরা একদিন এসে ছয় দিনের স্বাক্ষর করেন হাজিরা খাতায়। লেখাপড়ার পরিবেশ না থাকায় তারা তাদের ছেলে-মেয়েকে অন্যত্র পাঠাচ্ছেন। সরকারি উচ্চমহলের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন তারা।

এলাকার দুজন স্কুল শিক্ষক জানান, পাঠদান না করায় মাদ্রাসাটির ইবতেদায়ি শাখায় কোনো শিক্ষার্থী নেই। উচ্চমহলের তদন্ত এলে পাশেই ভুড়িধোয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ডেকে নিয়ে দেখানো হয়। মূলত, ইবতেদায়ি শাখাটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তারা। মোস্তফি ভুড়িধোয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার আবুল বাশার নাঈমী বলেন, ‘অজ্ঞাত কারণে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কয়েক দিন ধরে মাদ্রাসায় আসছে না। তাই পাঠদান হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা না এলে শিক্ষকদের কী করার আছে, আপনারাই বলুন?’ তবে ইবতেদায়ি শাখার শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে পারেননি। উল্টো একাডেমিক ভবন দাবি করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close